‘ডালিম পাকিলে এমনি ফাটিয়া যায়’
আমার শৈশবকালটা ছিল ডালিমময়।
বাবা যে জুট মিলে চাকরি করতেন সেখানেই আমরা থাকতাম। পাশের বাসায় থাকতেন মান্নান চাচা। তার তিন ছেলে। আঙুর, জামরুল ও আপেল। আপেল সবার ছোট এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, লোকজন আপেলকে ডাকত ডালিম!
বাবার আরেক সহকর্মী জব্বার চাচার স্ত্রী সেলাই কর্মে খুব ভালো ছিলেন। তিনি সূচিকর্মের মাধ্যমে দুই লাইন লিখেছিলেন যা বাঁধাই করে দেয়ালে টানিয়েও রেখেছিলেন। আজও মনে থাকা সেই দুই লাইন হচ্ছে– ‘ডালিম পাকিলে এমনি ফাটিয়া যায়/ ছোটলোক বড় হলে বন্ধুরে কাঁদায়!’
পল্লীকবি জসীম উদদীনের ‘কবর’ কবিতার প্রথম দুই লাইন হচ্ছে– ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে/ তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’
খুলনায় আমরা যে কলোনিতে থাকতাম সেখানে ডালিম গাছের আধিক্য ছিল। ছিল সবার অগোচরে ডালিম চুরির রেওয়াজও। ছোটকালে ডালিম কুমারের রূপকথার গল্প বহুবার শুনেছি। ডালিম কুমারের প্রতি সেই ভালোবাসা হয়তো এখনও অনেকেরই আছে। খুলনার খালিশপুর-দৌলতপুর এলাকার একজন সংসদ সদস্য ছিলেন যার নাম কাজী সেকান্দার আলি ডালিম। একদা তিনি বিএনপি করতেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য হন। যদিও আড়ালে আবডালে কেউ কেউ তাকে বলত ‘ডিগবাজি ডালিম’। কথায় কথায় শ্রদ্ধেয় ডালিম ভাইয়ের নাম চলে আসল। আমরা বরং কথা না বাড়িয়ে শুধু ডালিম নিয়েই থাকি।
আনার, বেদানা বা ডালিমের বৈজ্ঞানিক নাম punica granatum, ডালিম আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসায় পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডায়াবেটিস রোগীরা ডালিমকে প্রাকৃতিক ইনসুলিন বলে থাকেন। কেটে গেলে বা নাক দিয়ে রক্ত বের হলে ডালিম পাতা বা ফুল বেটে লাগালে উপশম পাওয়া যায়। রাস্তার পাশের ক্যানভাসাররা যে কৃমির ওষুধ বিক্রি করেন সেখানেও আছে ডালিমের ব্যবহার। ক্যানভাসাররা কাব্য করে বলেন– ‘রাইতের বেলা আম্বিয়ার বাপ চিৎকার কইরা কয় ধরছি ধরছি। আম্বিয়ার মা হারিকেন বাত্তি জ্বালাইয়া দেখে আম্বিয়ার বাপ কিছুই ধরতে পারে নাই। জনাব গুড়া কিরমি ধরা যায় না গুড়া কিরমি মারতে হয়। গুড়া কিরমি মারার জন্য দরকার ডালিম গাছের শেকড় দিয়ে বানানো এই ওষুধ।’
ডালিমের আরও বহুগুণ আছে। আমাশয় ও শিশুদের পেটের রোগ নিরাময়ে ডালিম কাজে লাগে। কিন্তু আমরা জানি প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। অ্যালার্জির সমস্যা থাকলে ডালিম খেতে নেই। ডালিম রক্ত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বিধায় শরীরে লাল লাল ছোপ পড়তে পারে। গ্যাস, অ্যাসিডিটি ও নিম্ন রক্তচাপ থাকলে ডালিম খাওয়া উচিত নয়। ডালিমে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে বলে কিডনি রোগীদের এটা খেতে মানা করা হয়। যারা মানসিক রোগে ভোগার কারণে ওষুধ খান ডালিম হতে পারে তাদের জন্য বিষের সমান।
আরবিতে ডালিমকে বলা হয় ‘রুম্মান’। এর আদি নিবাস নাকি পারস্য অঞ্চলে। এটাকে জান্নাতি ফলও বলা হয় কারণ পবিত্র কোরানের তিন স্থানে রুম্মান বা ডালিমের কথা আছে। খেজুরকে বলা হয় খাবার ফল কিন্তু আনার বা ডালিমকে বলা হচ্ছে ফল ও ওষুধ। ইংরেজিতে ডালিমকে বলা হয় সুপার ফ্রুট। আসলে ডালিমের গুণাগুণ বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়।
ডালিম সব দেশেই কম বেশি পাওয়া যায়। তবে ফল হিসেবে ডালিম কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্ডার রেটেডও। গানে লাউ বা জাম্বুরা থাকলেও ডালিম নেই বললেই চলে। যেমন ‘সাধের লাউ বানাইলো মোরে বৈরাগী’ কিংবা আমার লাউয়ের পিছে লাগছে বৈরাগী’। আইটেম গানের কথায় আছে– ‘ও ছেড়ি তোর গাছে পাকা জাম্বুরা ফল কে খাবে?’ কিন্তু ডালিমের কথা নেই বললেই চলে, যা দুয়েকটা আছে তা বড় বেশি অশ্লীল। বিটিভিতে প্রচারিত একটা নাটকের নাম ছিল ‘রূপবান ও ডালিমকুমার’। ডালিমকুমার এবং পঙ্খিরাজও আছে নাটকে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ডালিম-বেদানা