গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ কি সত্যিই শেষ হয়েছে?
রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্য সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় অনেক সময় এমন অনেক কথা বলেন যা হয়তো শুধু তাৎক্ষণিক বাহবা পাওয়ার জন্যই বলেন, যার হয়তো স্থায়ী কোনো গুরুত্ব নেই। এই বাস্তবতায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ৩ জানুয়ারি দিনাজপুর সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী ও গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অনেকের নজর কেড়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর সরকারি কলেজে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতিতে এসেছেন। ছাত্র জীবনেও অবশ্য তিনি ছাত্র আন্দোলনে শরিক ছিলেন। একজন সজ্জন মানুষ হিসেবে মির্জা ফখরুলের সুনাম আছে। তবে দলীয় রাজনীতির স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে তিনিও নন।
আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশই অতিকথন দোষে দুষ্ট। এ ক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল অবশ্যই কিছুটা ব্যতিক্রম। তো, দিনাজপুর কলেজে বিএনপি মহাসচিব তার বক্তৃতায় বলেছেন, “শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, একটি সুখী সুন্দর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশকে আমরা নির্মাণ করার চেষ্টা করছি। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি। পরে গণতন্ত্রের যুদ্ধেও ছিলাম। আজকে সেই গণতন্ত্রের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা ঐক্যের যে যুদ্ধ– সকলে মিলে দেশটাকে যে গঠন করব, একটা পথরেখা দেখাব আমার এমন মনে হয় এই জায়গাটাতে আমাদের ব্যর্থতা আছে। কিন্তু কেন জানি না আমরা সেই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছি না।”
মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের ছেলেরা জীবন দিয়েছে, আমাদের রাজনৈতিক কর্মীরা দীর্ঘদিন অমানবিক নির্যাতন সহ্য করেছে। সাত থেকে আট শ’ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গুম করা হয়েছে। ৬০ লাখের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এই অবস্থা আমরা পার হয়েছি। একটা নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; কিন্তু কেন জানি না আমরা সেই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছি না। আমি সংশ্লিষ্ট সবার কাছে এই আবেদন জানাব, আমরা এই সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়াই। সবাই মিলে আমরা একটা সুস্পষ্ট সুন্দর পথ নির্ধারণ করি। যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, সে স্বপ্নকে আমরা বাস্তবায়ন করি।”
বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, “নেতিবাচক চিন্তা করলে হবে না। আমাদের পরস্পরকে সহনশীলতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সম্মান করতে হবে। যে রাজনৈতিক চিন্তাই করি না কেন, দেশপ্রেম যদি থাকে, দেশের প্রতি ভালোবাসা যদি থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই আজকে যে সুযোগ এসেছে, সে সুযোগের সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারি।”
ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। দেশের সব সম্পদ লুণ্ঠন করে প্রতিবছর ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। সেই হিসাবে গত ১৫ বছরে ২৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশে পাচার করেছে। বিগত ১৫টি বছর দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি।”
বাংলাদেশের রাজনীতি দীর্ঘ সময় ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে লিপ্ত। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জনগণের কণ্ঠে বারবার শোনা গেছে গণতন্ত্র রক্ষার আহ্বান। কিন্তু ওই সংগ্রামের ফসল কি প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের বিকাশে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত হয়েছে? বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য এ প্রশ্নের একটি প্রতিধ্বনি হয়ে দাঁড়ায়। দিনাজপুরে দেওয়া তার বক্তব্যে তিনি যে সংকট ও সুযোগের কথা বলেছেন, তা আমাদের সবাইকে নতুন করে ভাবার আহ্বান জানায়।
মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক যুদ্ধ শেষ হয়েছে।’ এই কথা একটি নতুন অধ্যায়ের সম্ভাবনাকে প্রতিফলিত করে। যদিও বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্য বহু রক্ত ঝরিয়েছে এবং দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পার করেছে, এখন প্রশ্ন হলো, গণতন্ত্র কি শুধুই ক্ষমতা ভাগাভাগির খেলা নাকি এটি প্রকৃত অর্থে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করার একটি পদ্ধতি? তাই গণতান্ত্রিক যুদ্ধ সত্যি শেষ হয়েছে বলে মন্তব্য করার সময় সম্ভবত এখনো আসেনি। তাছাড়া ত্রুটিমুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ রাতারাতি পাওয়াও যায় না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গণতন্ত্র রক্ষা