যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের স্বার্থ সুরক্ষায় যা করতে হবে
যুক্তরাষ্ট্র প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমরনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ছাড়া ১৯৯০-পরবর্তী প্রায় এক মেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় ক্ষমতার মেরুকরণে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনো প্রায় ‘অদ্বিতীয়’। এসব নানা রকম কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোও নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় বিভিন্ন কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি, যোগাযোগ রক্ষা ও সম্প্রসারণের চেষ্টা করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও নীতিকাঠামোতে বিদেশি রাষ্ট্র বা পক্ষগুলোর বৈধ সম্পৃক্ততার সুযোগ রাখা হয়েছে (লবিংয়ের মাধ্যমে)। এর ফলে দেখা যায়, বৃহৎ প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র চীন থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুর বা কাতার পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের এই অভ্যন্তরীণ নীতিকাঠামোতে নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষায় সক্রিয়ভাবে নিয়োজিত থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ স্বার্থ রয়েছে। আমাদের মূল রপ্তানি পণ্য রেডিমেড গার্মেন্টস বা তৈরি পোশাকের একক বৃহত্তম বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র (ব্লক হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন)। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ, বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য জিএসপি–সুবিধা বহাল ও সম্প্রসারণ, প্রযুক্তি স্থানান্তর, গবেষণা সহযোগিতা, গভীর সমুদ্রে সম্পদ আহরণ—এসব বিষয়ও রয়েছে।
এসব বিবেচনায় অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন, আন্তসীমান্ত মাদক চোরাচালান ও মানব পাচার রোধ, মিয়ানমার ও ভারতীয় সীমান্তে নানামুখী হুমকি ও অস্থিরতার মতো ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কৌশলগত মিত্র হতে পারে।
কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় দূরদৃষ্টি ও কর্মকৌশল না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও নীতি প্রণয়ন কাঠামোয় বাংলাদেশের হয়ে কোনো পদ্ধতিগত ও সংগঠিত প্রচেষ্টা প্রায় অনুপস্থিত। এ কারণে বাংলাদেশবিরোধী নানা পক্ষ, যারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নের জটিল প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত, তারা এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে। এ দুর্বলতা কাটানোর উপায় কী হতে পারে?
পেশাগত ও কৌশলগত নানা কারণে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আমার প্রায় অর্ধদশকের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও নীতিকাঠামোর কর্মযজ্ঞ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে।
এই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার আলোকে আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ সুরক্ষায় রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের জটিল নীতিকাঠামোয় বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে, তা নিয়ে এ লেখায় কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি পদ্ধতিগতভাবে দেশের স্বার্থ সুরক্ষায় কাজে লাগতে পারে, সে রকম কিছু পরামর্শ উপস্থাপন করছি।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি কাঠামোয় কিছু দৃশ্যমান, কিছু অদৃশ্য ‘ক্রীড়নক’ রয়েছে; যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা কেবল দুটি পক্ষের উপস্থিতি দেখি।
প্রথম পক্ষ হচ্ছে সরাসরি নীতিনির্ধারণে সম্পৃক্ত সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, হোয়াইট হাউসের সিনিয়র কর্মকর্তারা এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি বা তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তারা।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছেন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। প্রায় প্রতিটি দেশের জন্যই স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি ডেস্ক থাকে এবং সেখানে এক বা একাধিক কর্মকর্তা নিযুক্ত থাকেন। তাঁরা বিভিন্ন দেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সঙ্গে মিলে মাঠপর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ, সংকলন, বিশ্লেষণ ও মেমো তৈরির কাজ করে থাকেন।
অর্থাৎ তাঁরা একটি ‘তথ্য–লুপ’ হিসেবে কাজ করেন। এই পর্যায়ের কর্মকর্তারা নীতিনির্ধারণের জন্য তথ্য ও বিশ্লেষণ তৈরি করেন। তাঁদের সরাসরি নীতিনির্ধারণী ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ কম। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক পর্যায় থেকে মূলত এই দুই স্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার চেষ্টা করা হয়।
কিন্তু এই দুই স্তরের বাইরেও আরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ রয়েছে, যারা পররাষ্ট্র বিভাগের কৌশলগত সিদ্ধান্তে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা দপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) তার অন্যতম। যদিও প্রথম দুটি স্তরের বাইরের রাষ্ট্রের নাক গলানোর ও প্রভাবিত করার সুযোগ একেবারেই সীমিত। কিন্তু এসবের বাইরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইকোসিস্টেম’ রয়েছে, যেটি সরকারের এসব নীতিনির্ধারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।