তৈলমর্দন, চামচাবাদ, চোরতন্ত্র: ক্লেপ্টোক্রেসি
তৈলতন্ত্র, চামচাবাদ ও চোরতন্ত্র যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে, সেখানে ক্লেপ্টোক্রেসির জন্ম হয় এবং দূষিত করে সমাজের মানুষ, সমাজ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি তথা দেশের পুরো সিস্টেমকেই। দেশের প্রতিটি শিরায় শিরায় এই দূষিত রক্ত প্রবহমান থাকে। সেখানে আইনগত কোনো সিস্টেম কাজ করে না, মেধা বা অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন হয় না।
এখানে যে যত চামচামি করতে পারবে, যত বড় চোর হবে, সে তত ভালো থাকবে, সমাজে নাম-ডাক থাকবে। সবাই তাকে চিনবে, বাহ্যিকভাবে সম্মানও করবে, কিন্তু মন থেকে তাকে পছন্দ করবে এমন একজন মানুষও পাওয়া যাবে না। মনের অজান্তেই তার জন্য দুটি গালি বের হয়ে যাবে।
এই চামচাবাদ যুগে যুগেই ছিল। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ের মতো কখনোই এত বেশি প্রকট আকার ধারণ করেনি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তো একটা বিখ্যাত কবিতাই লিখে ফেলেছিলেন এই তৈলমর্দন নিয়ে—
সাহেব কহেন, 'চমৎকার! সে চমৎকার!'
মোসাহেব বলে, 'চমৎকার সে হতেই হবে যে!
হুজুরের মতে অমত কার?'
সাহেব কহেন, 'কী চমৎকার,
বলতেই দাও, আহা হা!'
মোসাহেব বলে,
'হুজুরের কথা শুনেই বুঝেছি,
বাহাহা বাহাহা বাহাহা!'
পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই তৈলমর্দনের স্তুতিগাথা এত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা বর্তমান সমাজের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়, 'বাস্তবিক তৈল সর্বশক্তিমান, যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যায় অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য—তাহা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।'
এই ক্লেপ্টোক্রেসি কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তার সুন্দর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। সম্প্রতি তিনি বলেন, 'বিগত বছরগুলোতে বিচারপ্রক্রিয়ায় আমাদের বিচারবোধ ও ন্যায়বিচারের মূল্যবোধকে বিনষ্ট ও বিকৃত করা হয়েছে। সততার বদলে শঠতা, অধিকারের বদলে বঞ্চনা, বিচারের বদলে নিপীড়ন, আশ্রয়ের বদলে নির্যাতনকে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত করা হয়েছে। অথচ এ রকম সমাজ–রাষ্ট্র আমরা চাই না।'
দেশের প্রতিটা খাতে চামচাবাদ আর চোরতন্ত্রে ভরপুর। যে যত বড় চামচা সে তত বেশি ভালো অবস্থানে ছিল, তত বড় চোর ছিল। চামচাবাদ বা চোরতন্ত্র সম্পর্কে সুন্দর বিশ্লেষণ দিয়েছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, 'যখন আপনার রাষ্ট্রক্ষমতা, আপনি যাদের দায়িত্ব দেন, সেটা আইনসভা বলেন আর নির্বাহী বিভাগ বলেন, অথবা বিচার বিভাগ বলেন, তারা সকলেই যখন গোষ্ঠীবদ্ধভাবে একটা চুরির অংশ হয়ে যায়, তখন সেটি চোরতন্ত্র এবং এই চোরতন্ত্রের ভেতরে আপনি দেখবেন যে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী একটি আমলা গোষ্ঠী। আমরা যখন বলি, আমরা তখন উর্দি পরা এবং উর্দি ছাড়া দুটোর কথাই বলছি এবং এর সঙ্গে আপনার রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী এবং আমরা—এই তিন সহযোগ সৃষ্টি করা হলো।'
চোরতন্ত্র বা ক্লেপ্টোক্রেসির কিছু তাৎপর্যপূর্ণ বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যাক।
২০২৪ সালে জাতীয় শ্বেতপত্রে অর্থপাচার ও দুর্নীতির এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। গত ১৫ বছরে ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে। এ হিসেবে প্রতি বছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ দুর্নীতি ও পাচার হয়েছে। চিন্তা করা যায়! অথচ, আমাদের রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন থাকলেই নিরাপদ মনে করি এবং এটা নিয়ে গর্ব করি। সেখানে এত অর্থ প্রতি বছর দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে! এটাতো চোরতন্ত্রের এক মহাউৎসব।
এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল ইসলাম (এস আলম) ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এস আলম নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো খালি হয়ে গেছে। এ তো পুকুর চুরি নয়, পুকুর ডাকাতি!
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য কেনা প্রতিটি বালিশের দাম ধরে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। ভবনে সেসব বালিশের প্রতিটি তুলতে খরচ ধরে ৭৬০ টাকা। ডাকাতির লেভেলটা কোথায়, চিন্তা করা যায়!
একটি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের জন্য প্রতিটি পর্দা ৩৭ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে। মনে হচ্ছে, স্বর্ণের পর্দা কিনেছেন তারা!
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের ছেলের ছাগলকাণ্ডের কথা সবাই জানে। এমন দুর্নীতিবাজ মতিউর রহমান আরও যে কত আছে, তা হয়তো আমরা জানিই না।
একজন পিয়ন যদি ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়, তাহলে আমরা দুর্নীতির কোথায় অবস্থান করছি, এটা চিন্তারও বাহিরে!
- ট্যাগ:
- মতামত
- অনিয়ম ও দুর্নীতি