পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যুগোপযোগী হোক
আমরা যখন দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকাই এবং আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে তার তুলনা করতে যাই, তখন অনেক বিস্ময় নিয়ে ভাবতে থাকি, সময়ের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবর্তন দরকার। কিন্তু সেটা কীভাবে? আমার কাছে কখনো মনে হয়নি এ পরিবর্তন করার জন্য খুব বেশি অর্থের প্রয়োজন, বরং বেশি প্রয়োজন আমাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির।
শুরুটা হোক শিক্ষকদের দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগে যারা শিক্ষকতা করছেন, তাদের আমরা দুটি গ্রুপে ভাগ করে নিতে পারি। একটি গ্রুপের ৮০ শতাংশ কাজ হবে ক্লাসরুমে পড়ানো; আর ২০ শতাংশ কাজ হবে গবেষণা করা। এ গ্রুপের শিক্ষকদের আমরা রাখব একাডেমিক পোস্ট দিয়ে-যেখানে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক হিসাবে শিক্ষকরা কাজ করবেন। প্রভাষক হিসাবে যারা যোগদান করবেন, তাদের পোস্ট হবে অস্থায়ী এবং পিএইচডি শেষ না করা পর্যন্ত তাদের স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হবে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে তাদের গবেষণা কাজের গুরুত্ব কম থাকবে, বরং তাদের ক্লাসরুমে পড়ানোর মান, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সমন্ধিত মতামত, চাকরির সময়কাল সবকিছুই বিবেচনা করা হবে।
অন্য একটি গ্রুপের ৮০ শতাংশ কাজ হবে গবেষণা করা, গবেষণার ফান্ডিং আনার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া, থিসিস মাস্টার্স, পিএইচডি আর পোস্টডক শিক্ষার্থীদের সুপারভিশন করা; আর ২০ শতাংশ কাজ হবে ক্লাসরুমে পড়ানো। এ গ্রুপের শিক্ষকদের আমরা রাখব গবেষক পোস্ট দিয়ে-যেখানে রিসার্চ প্রভাষক, রিসার্চ সহকারী অধ্যাপক, রিসার্চ সহযোগী অধ্যাপক ও রিসার্চ অধ্যাপক হিসাবে শিক্ষকরা কাজ করবেন। প্রভাষক হিসাবে যারা যোগদান করবেন, তাদের অবশ্যই পিএইচডি থাকতে হবে, একইসঙ্গে এক বা একাধিক পোস্টডক থাকলে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ভালো প্রকাশনা, গবেষণার ফান্ডিং আনার দক্ষতা, পিএইচডি সুপারভিশন করার দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে ক্লাসরুমে পড়ানোর মান নির্ণয়ে কম গুরুত্ব থাকবে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠারও দরকার রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগে দেশের চাহিদার কথা বিবেচনা করে প্রফেশনাল প্রোগ্রাম শুরু করা জরুরি, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলবে। এ প্রফেশনাল প্রোগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি সব শিক্ষক যেন আর্থিকভাবে উপকৃত হন, সেটাও বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া গবেষণার ফান্ডিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা অ্যালামনাই রয়েছেন, তাদের অব্যশই এগিয়ে আসতে হবে। অ্যালামনাইদের আর্থিক অনুদানের বিষয়ে নিয়মিত অবগত করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও থাকতে হবে। আমরা জানি, যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হচ্ছে তার শিক্ষার্থীরা আর শক্তি হচ্ছে তার অ্যালামনাই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা অ্যালামনাই রয়েছেন, তাদের কীভাবে আরও কার্যকরভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সেটাও আমাদের ভাবতে হবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। কারণ, একজন শিক্ষকের একমাত্র কাজ শিক্ষকতা ও গবেষণা করা। পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশে আমি কোনো শিক্ষককে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতে দেখিনি। বরং এ দায়িত্ব পালন করার জন্য আলাদাভাবে সেসব কাজের দক্ষতা অনুযায়ী লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে সব শিক্ষকের কাছে বছরের শুরুতে তাদের বাৎসরিক কর্মপন্থা জমা দেওয়ার অনুরোধ জানানো যেতে পারে, যা পরবর্তী বছরে শিক্ষকদের মূল্যায়নে ভূমিকা রাখবে। আরেকটি বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের আবাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও আবাসন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার গুরুত্ব দিতে হবে, একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশের উন্নয়নের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়েরই অভিযোগ হয়েছে। আমরা এখনো আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি। মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে, তাহলে শিক্ষার্থীরা সারা বছর পড়াশোনার মধ্যে থাকবে এবং পরীক্ষার আগে পড়ে পাশ করার প্রবণতাও কমে আসবে। মাস্টার্স ও পিএইচডি শিক্ষার্থীদের অবশ্যই শিক্ষক সহকারী হিসাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত, যা তাদের পরবর্তী সময়ে কাজের অভিজ্ঞতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে এবং শিক্ষকদেরও কাজের চাপ অনেকটাই কমে আসবে। একইসঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়নে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।