বন খেল সরকার, চিংড়ি বারোভূতে
‘আমার একটা নদী ছিল’র মতো হৃদয়স্পর্শী আরেকটি গান হতে পারে, ‘চকরিয়ায় একটা সুন্দরবন ছিল’। এই বনের আয়তন ছিল সাড়ে ৪৫ হাজার একর; আসল সুন্দরবনের প্রায় ৭ ভাগের ১ ভাগ। এই বনেও ছিল কেওড়া, বাইন, সুন্দরীর মতো শ্বাসমূলীয় গাছপালা। বনে ঘুরে বেড়াত হরিণ, বানর, বাঘ। নদী-খালের নোনাজলে ছিল মাছ, কাঁকড়া, কুমির। এই চকরিয়া সুন্দরবনও দেশের একটি বিশাল জনপদকে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচিয়ে দিত নিজের বুক পেতে। কিন্তু আজ আর কিছুই নেই।
কেন নেই, কীভাবে নেই, কারা ‘নেই’ করল সব—প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে মাঠে নেমে জানা গেল, মানুষের হাতেই ধ্বংসের সূত্রপাত এ সুন্দরবনের। আর ধ্বংসের ষোলোকলা পূর্ণ করে অন্য কেউ নয়, দেশের মানুষ ও সম্পদ দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া সরকারগুলো। নিজেদের সমর্থকগোষ্ঠী প্রভাবশালী লোকজনের কাছে ইজারা দিয়ে সেখানে চিংড়ি চাষের ব্যবস্থা করে উজাড় করা হয় আস্ত একটা সুন্দরবন। একটা দেশের সরকারের হাতে প্রকৃতি ধ্বংসের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার কথা আগে জানা গেলেও গত তিন মাসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এখন সেখানে কী চলছে! দেখা গেছে, একসময় যে মাটিতে দৃঢ় শ্বাসমূল-ঠেসমূলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল ম্যানগ্রোভ গাছের গহিন বন; এখন সেখানে শুধুই নোনাপানির ঘের আর তার গভীরে ঘটে চলা অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দখল-রাহাজানির এক কালো অধ্যায়।
উপকূলের এই দ্বিতীয় প্রহরীখ্যাত কক্সবাজারের চকরিয়া সুন্দরবনে প্রথম সরকারি কোপ পড়ে ১৯৭৮ সালে। দেশে চিংড়ি চাষ প্রসারের কথা বলে রামপুর মৌজায় প্যারাবনের (এই অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন) বেশির ভাগ জমি ইজারা দেয় তখনকার বিএনপি সরকার। পরে ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকার আবার সেই ইজারা বাতিল করে নতুন করে দুই দফায় মোট ৭ হাজার একর বনভূমি ইজারা দেয়। ইজারাদারেরা নিজ নিজ অংশের বন উজাড় করে মাটি কেটে পাড় বেঁধে তৈরি করেন চিংড়িঘের। ২ থেকে ৫ ফুট গভীরতার সেসব ঘের এখনো আছে; কিন্তু যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল, তা প্রায় ভেস্তে গেছে। ঘের ব্যবস্থাপনার জন্য নীতিমালা করা হলেও তা রয়ে গেছে কাগজেই। ইজারাদারেরা কেউ চিংড়ি চাষ না করে নীতিমালা ভেঙে ঘেরগুলো অন্যদের কাছে সাবলিজ দিয়ে অর্থ আয় করছেন। ঘের ঘিরে গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসী চক্র। সব আমলে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাসীরা সেখানে ‘যা খুশি তাই’ করে চলেছে। সব অপকর্মের দোসর হয়ে ফায়দা লুটছেন মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। অনুসন্ধানকালে চকরিয়া চিংড়িঘেরের ১৫ জন ইজারাদার; সাবলিজ নেওয়া ৫০ জন চিংড়িচাষি; মৎস্য অধিদপ্তরের ১০ জন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ঘেরসংশ্লিষ্ট অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে আজকের পত্রিকার এই প্রতিবেদকের।