আওয়ামী লীগের মতাদর্শিক দুর্বলতা
আন্দোলনে ভূমিকা রাখা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা বিভিন্ন পাঠচক্রে বিদেশী এবং দেশী চিন্তকদের চিন্তাভাবনা আলোচনা, পড়াশোনা করেছেন। কিছু পাঠচক্র গড়ে তুলবার নেপথ্যে ‘ইন্টেলেকচুয়াল ফোর্স’ হিসেবে হিযবুত তাহরীরের ছাত্র কর্মীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে।
একসময় যেখানে পাঠচক্র গড়ে উঠত মার্কসবাদী চিন্তাধারাকে জানা-বোঝার জন্য, ওই জায়গাটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইসলামকে ভিত্তি ধরে সমাজ, রাজনীতি এবং ইতিহাসের অধ্যয়নে। এই তরুণরা চেয়েছেন বাংলা-ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে জনপরিসর আওয়ামী লীগ তৈরি করেছে, তার বিপরীতে ইসলামকে কেন্দ্রে রেখে একটা কাউন্টার জনপরিসর তৈরি করতে।
এরকম একটি জনপরিসর গঠন ছাড়া আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করা যাবে না বলে তারা মনে করেছেন। এ জনপরিসরের ধারণা যে একেবারে নতুন তাও নয়। ১৯৪৭ সালের আগে থেকেই এ জনপরিসর বাংলায় তৈরি হয়েছিল। তরুণ শিক্ষক এবং ছাত্রবৃন্দ চেষ্টা করছেন ওই জনপরিসরকে তাত্ত্বিকভাবে আধুনিক করে তুলতে।
এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব যে জনপরিসর সেটাকে বর্তমান সময়ের যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের যে রাজনৈতিক ভাবনা, তার উপযোগী করে আধুনিকায়ন করতে পারেনি। বস্তুত এর প্রয়োজনীয়তাও তারা বোধ করেনি।
আওয়ামী নেতৃত্ব এবং আওয়ামী ব্যানারে সুবিধাপ্রাপ্তদের একটাই লক্ষ্য ছিল, যে মতাদর্শকে ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সেটাকেও ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করে অর্থনৈতিক লুটপাট, টাকা পাচার এবং ঋণ খেলাপি হওয়া। মতাদর্শের তাত্ত্বিক উন্নয়ন নয় বরং ১৯৭১-এর রাজনৈতিক মতাদর্শকে তাদের অবৈধ, অনৈতিক কার্যকলাপের ঢাল বা রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করা।
সাধারণত মতাদর্শের জন্ম হয় সে সময়কার রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবার জন্য। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ওই মতাদর্শের তাত্ত্বিক উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে তা স্থবির হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যা করতে পারে না। ফলে নতুন যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয় তাত্ত্বিকভাবে তার পক্ষে তা মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না। আর এ মোকাবেলা করতে পারবার ব্যর্থতার কারণে আমরা দেখেছি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন।
তেমনিভাবে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক দর্শন সেটি ১৯৭১ সালের বাস্তবতাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। সেটির তাত্ত্বিক উন্নয়ন ছাড়া, ২০২৪ সালের যে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ— জনগণ বিশেষত তরুণ সমাজের রাজনৈতিক এবং সামাজিক মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে ওইসমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যাবে কিনা— এ ধরনের কোনো রাজনৈতিক বোধ আওয়ামী নেতৃত্বের মধ্যে পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিল এবং এখনো রয়েছে।
জনগণ টেক্সট পড়ে কোনো মতাদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। তারা আকৃষ্ট হয় ওই মতাদর্শের অনুসারী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জীবনাচরণ দেখে। পাশাপাশি যে বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয় তা হলো, এই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীরা সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারছেন কিনা। জনগণের মৌলিক সমস্যার সমাধানে উদ্যোগী হচ্ছেন কিনা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দুর্বলতা
- গণআন্দোলন
- মতাদর্শ
- আওয়ামী লীগ