শ্রমবাজারে শিশুশ্রমিক : প্রতিরোধে করণীয় কী?
আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘শিশুশ্রমিক’ শব্দটি আমরা মনে নিতে না পারলেও মেনে নিতে বাধ্য হই। ‘শিশু’র সাথে ‘শ্রমিক’ শব্দটি যায় না। কিন্তু এরপরেও আমাদের বাসাবাড়ি, কারখানা, গ্যারেজ, হোটেল, নির্মাণ কাজ ও গণপরিবহণসহ অন্য সব জায়গায় অসংখ্য শিশু কাজ করছে। এরা যেখানে কাজ করে, সেখানে কাজের পরিবেশ খুব নিম্নমানের।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে নানা ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে কাজ করতে বাধ্য করা হয় শিশু শ্রমিককে। শিশু শ্রমিকের মজুরিও অন্যান্য শ্রমিকের তুলনায় চারভাগের একভাগ। শিশুকে সহজেই নানাধরনের নিপীড়ন করা যায় বলে, শ্রমবাজারে তাদের চাহিদা বেশি।
আমরা প্রতিবছর শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষাকল্পে শিশুশ্রম বন্ধে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে এক হয়ে কাজ করতে বলি। শিশু শ্রমিকের উপর নিপীড়ন বন্ধে প্রতিবছর ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। নানা রকমের আলোচনা হলেও তেমন কোনো উদ্যোগই কার্যকর হয় না। আর কর্মজীবী শিশুরা অমানবিক পরিবেশেই কাজ করে, বেঁচে থাকে।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২ অনুযায়ী ১০ বছরে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৭৭ হাজার। তবে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের সংখ্যা কমেছে। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশ শিশুশ্রম নিরসনের বৈশ্বিক লক্ষ্য ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে হবে কিন্তু তা অর্জনে অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
শিশুশ্রম একটি শোষণমূলক প্রক্রিয়া বলেই অনেক দেশই একে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ১৫ বছর বয়সের একটি শিশুকে কর্মশক্তিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়। তবে আইএলও শিশুশ্রমকে সংজ্ঞায়িত করেছে এইভাবে, ‘এমন কাজ, যা একটি শিশুর বয়স এবং কাজের ধরন অনুসারে ন্যূনতম সংখ্যক ঘণ্টা অতিক্রম করে’। কিন্তু পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে এদেশে শিশু কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এখানে দরিদ্র পরিবার বা বাবা-মা শিশুর জন্ম দেয় ঠিকই কিন্তু তাদের লালনপালনের ব্যবস্থা নিতে পারেন না। একটু বড় হওয়ার পর শিশুকেই নিজের ভাত-কাপড়ের দায়িত্ব নিতে হয়। তাই দরিদ্র শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়ে এবং কাজের মধ্যে ঢুকে যায়।
অন্যভাবে বলা যায়, শিশুশ্রম বন্ধ করা মানে শিশুকে অভুক্ত রাখা। সেক্ষেত্রে শিশুদের জন্য কাজের এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার, যেখানে শিশু ভালো পরিবেশে থাকতে পারবে, কষ্টকর ও বিপদজনক কাজ করানো না, ভালো খাবার ও বিশ্রাম পাবে, পরার কাপড় পাবে, চিকিৎসা ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে এবং পড়াশোনা করার কিছুটা সুযোগ পাবে।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ স্বাক্ষরের ৩৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। মূলত এ সনদের মাধ্যমেই শিশুদের অধিকার যে মানবাধিকার তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এ সনদে অনুস্বাক্ষর করে।
বাংলাদেশ শিশুশ্রম বন্ধ করতে চায় কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এর প্রতিকূলে। যদিও এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে সব ধরনের শিশুশ্রম থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। দেশ থেকে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করতে বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘জাতীয় শিশুশ্রম কল্যাণ পরিষদ’ কাজ করছে। সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের পুনর্বাসন এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর বিকাশ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ও ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বিষয়ক আইএলও কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে।
শুধু যে ঘরে-বাইরে কঠিন কাজ করানোর মাধ্যমে শিশুর অধিকার লঙ্ঘন করা বা নির্যাতন করা হয়, তা কিন্তু নয়। এর পাশাপাশি জোরপূর্বক শ্রম, আধুনিক দাসপ্রথা ও মানবপাচার, শিশুকে পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহার করা, যৌন ব্যবসায় জড়িত করা ও শিশুদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠানো নিকৃষ্ট ধরনের অপরাধ। শিশুশ্রমসমূহ নিষিদ্ধ ও নির্মূলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।