শিক্ষিত জাতিসত্তার সন্ধানে নবযাত্রা
ঘনঘন মত বদল বা বিষয় বদলে রাজনীতি অভ্যস্ত হতে পারে কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার জন্য তা ভয়াবহ। যে সরকার পনের-ষোল বছর ধরে দেশের ঘাড়ে ভর করেছিল তার কাছে আমাদের প্রত্যাশার মূল্য ছিল না। তারা তাদের ইতিহাস তাদের মতো করে বলে-পড়ে-শিখিয়ে শেষপর্যন্ত টিকতে পারেনি। তারা ভয়াবহ একপেশে শাসনে যে সমস্যা তৈরি করে রেখে গেছে, তা আজ গিলতে চাইছে সবকিছু।
আজকাল ছেলেমেয়েদের ধৈর্য খুব কম। প্রযুক্তি এই ধৈর্যহীনতা তৈরি করেছে। যখন প্রযুক্তি ছিল সীমিত তখন আমাদের আশ্রয় ছিল বই-পুস্তক। মানুষ বই পড়ত, বই ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞান। এর ভেতর একধরনের শান্তি ছিল। মনে রাখতে হবে দর্শন, শ্রবণ আর পাঠ— এই তিনের সমন্বয় আছে পাঠে। এখন এর যেকোনো একটা কাজ করে। দেখা মানে দ্রুত দেখতে থাকা। তারপর সেখান থেকে সরে অডিওতে যাওয়া। এই যে টানাটানি বা দোলাচল এতে শান্তি নেই। শান্তিহীনতায় ভুগতে ভুগতে আজকের প্রজন্ম বই পড়তে ভুলে গেছে। তারা জানে না পাঠে নিমগ্ন থাকা মানে এক ধরনের মনসংযোগের ব্যায়াম। এই যে পাঠ অনীহা, এর ফলে আজ `আজই চাই' জাতীয় এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়ে গেছে।
নবীনদের সবসময় দোষারোপ করার চাইতে তাদের দিকে মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে। বলতে পারি সময় বয়ে যাচ্ছে। এখনই তাদের শিক্ষায় না ফেরাতে পারলে অপমান আর অবমাননার যুগ শেষ হবে না। মনে রাখা ভালো এভাবে মেধা-শ্রম আর সময়ের অপচয়ে আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছি মাত্র। নিয়ন্ত্রণ বা জবরদস্তি যে ভালো ফল বয়ে আনে না সেটা আমরা জানতাম এবং দেখতাম, কিন্তু মানতাম না। অথচ আজকের বাংলাদেশে তারুণ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে জোর করে কিছু গেলানো যায় না। বরং জোর করে ইতিহাস গেলালে তাতে যে বদহজম হয় তার ফলাফল ভয়াবহ।
দেশ গঠনে তারুণ্যের বিকল্প নেই। তাদের সহযোগিতা আর অংশগ্রহণ ব্যতীত কোনোভাবেই সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে না। বলা উচিত তারাই হবে চালিকাশক্তি। এই চালিকাশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে শিক্ষার মূল বিষয়ে ফিরতে হবে। অচিরে তা না হলে এগুতে পারব না আমরা। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে আসলে শিক্ষা কী?
শিক্ষা বিষয়ে আমরা যা ভাবি তা কিন্তু কেবল একধরনের সীমাবদ্ধ ভাবনা। অথচ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শন মূলত চিন্তা বা ভাবনার স্বাধীনতা, হৃদয়ের স্বাধীনতা এবং ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা— এই তিন প্রকার স্বাধীনতার ধারনার ওপর প্রতিষ্ঠিত। শান্তি নিকেতনের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এই ধারণাকে ব্যাখ্যা করে উল্লেখ করেছেন, এই স্বাধীনতা কেবল মনের প্রসারতার উপর নির্ভর করে। রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করেছেন, মানুষের পূর্ণতা প্রাপ্তির এই ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষার দুটি পরস্পর সংযুক্ত উপাদান আছে— একটি ব্যক্তিগত পূর্ণতা এবং অপরটি সামাজিক পূর্ণতা। এই দুই ধরনের পূর্ণতা একে অপরের প্রতিযোগী নয়, বরং সহযোগী। একটি অপরটির পরিপূরক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্ত্রীশিক্ষা প্রবন্ধে লিখেছেন, “যাহা-কিছু জানিবার যোগ্য তাহাই বিদ্যা, তাহা পুরুষকেও জানিতে হইবে, মেয়েকেও জানিতে হইবে— শুধু কাজে খাটাইবার জন্য যে তাহা নয়, জানিবার জন্যই। মানুষ জানিতে চায় সেটা তার ধর্ম; এইজন্য জগতের আবশ্যক অনাবশ্যক সকল তত্ত্বই তার কাছে বিদ্যা হইয়া উঠিয়াছে।” জ্ঞান সঞ্চারের ক্ষেত্রে কোনো লিঙ্গ, জাতি বা ধর্মের বিচার চলে না। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সকল জ্ঞানে সকলের অধিকার আছে। কারণ এই জ্ঞান একক ব্যক্তি বা দেশের সৃষ্ট নয়। পৃথিবীর সকল দেশের সর্বকালের সব মানুষের সৃষ্ট জ্ঞানের ধারা জ্ঞানসমুদ্র সৃষ্টি করেছে। (গ্রন্থাগার: রবীন্দ্রনাথ; অমিয় চক্রবর্তী)
- ট্যাগ:
- মতামত
- পরিবর্তন
- শিক্ষাব্যবস্থা
- সংস্কার কাজ