সাত কলেজ নিয়ে অপরিণামদর্শিতা
দেহের আকার-আকৃতি মোটা নাকি চিকন, বেঁটে নাকি লম্বা-তা কারও কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলেও, সবার কাছে নয়। ঠিক তেমনি বেশিদিন নাকি কম দিনের মন্ত্রী, তাও আলোচনার বিষয় নয়, যদি তার উদ্দেশ্য মহৎ ও হৃদয় খোলা থাকে। চালকুমড়ার আকার বড়, অথচ পিষলে এর থেকে বের হয় পানি। অন্যদিকে তিল বা সরিষা? কত ছোট শস্যদানা; কিন্তু ভেতরটা মূল্যবান তেলে ভরা। তেমনি সদিচ্ছা আর যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে কম দিন দায়িত্বে থেকেও ভালো কিছু করা যায়। অন্যদিকে, দায়িত্ব পালনে অমনোযোগী-উদাসীন হলে কিংবা অযথা বাগাড়ম্বরে মগ্ন থাকলে, বেশিদিন দায়িত্বে থেকেও কাজের কাজ কিছুই করা যায় না। শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের হয়েছে অনেকটা এমনই দশা।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বর্তায় মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ওপর। তার সময়ের নেতাদের মধ্যে মৌলানা আজাদের মেধা, পাণ্ডিত্য ও যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধ হিসাবে সুপরিচিত এবং কংগ্রেসের রেকর্ড পাঁচবারের সভাপতি ছিলেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর (১৯৪৭-১৯৫৮) তিনি দেশটির শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সম্পর্কে বলা হয়, ভারতের মতো একটি সদ্যস্বাধীন হওয়া বড় দেশে দীর্ঘদিন মন্ত্রী হিসাবে পদাসীন থেকে শিক্ষাক্ষেত্রের অগ্রযাত্রায় তিনি বুননের কাজটি শুরু করে গেছেন। অবশ্য সেরূপ কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশও পেয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের মতো দীর্ঘস্থায়ী সরকার তার চলার পথ সুগম করে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই এমন স্থায়িত্বের ফল-ফসল ঘরে তুলেছে এবং তুলে চলেছে ভারত। শিক্ষার অগ্রগতি ও প্রসার এবং জাতির কল্যাণে তার অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ভারত সরকার মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারতরত্ন’ খেতাব প্রদান করে। তার জন্মদিনটিকে (১১ নভেম্বর) ভারতে ‘জাতীয় শিক্ষা দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়।
বলতে গেলে দেশে আশির দশকজুড়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কী-যে অরাজকতা, নৈরাজ্য আর খামখেয়ালিপনা সংঘটিত হয়েছে, তা অল্পকথায় বলে শেষ করা যাবে না। মাত্র এক বছরের মধ্যে একের পর এক পাঁচজন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন! দুনিয়ার ইতিহাসে কোথাও এমন নজির আছে কিনা, আমার জানা নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো দেশে এমন অপরিণামদর্শিতাও সচরাচর লক্ষ করা যায় না। আহা, কী তামাশাটাই না করা হয়েছে সময় সময় শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে! জানি না, এমন খামখেয়ালিপনার জন্য জাতি আমাদের ক্ষমা করবে কিনা।
১৯৮৬ সাল, মানে একটিমাত্র বছর। মাসের হিসাবে ১২ মাস। আর দিনের হিসাবে ৩৬৫ দিন। উল্লিখিত ওই এক বছরে (১৯৮৬) একের পর এক মোট পাঁচ ব্যক্তি বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শামসুল হুদা চৌধুরী থেকে শুরু করে মোমিনউদ্দিন আহমেদ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকারী পাঁচ শিক্ষামন্ত্রীর (এক বছরে অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে) মধ্যে কেউ পাঁচ মাস, কেউ আড়াই মাস, এমনকি কেউ দুই মাসের জন্যও পদাসীন ছিলেন। ডা. এম এ মতিন দুই দফায় আড়াই মাসের জন্য ছিলেন দেশের শিক্ষামন্ত্রী। এছাড়া এ কে এম নূরুল ইসলাম দুই মাসের এবং মোমিনউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাঁচ মাস মেয়াদের শিক্ষামন্ত্রী। এম এ মতিন, একেএম নূরুল ইসলাম এবং মোমিনউদ্দিন আহমেদ ছাড়া ১৯৮৬ সালে দায়িত্ব পালনকারী অন্য দুজন শিক্ষামন্ত্রীর নাম শামসুল হুদা চৌধুরী ও মাহবুবুর রহমান।
অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে, আন্দোলন আর সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান সফল পরিণতি লাভ করে। যেমনই হোক, দেশে নতুন করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়। ১৯৯১ সাল থেকে সরকারব্যবস্থায় আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি নতুন টার্ম যুক্ত হয়, যেগুলো আগে কখনো শুনতে পাওয়া যায়নি। এ সময় (১৯৯১) থেকে পৌনঃপুনিকভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত ও পরিচালিত হওয়ায় উভয়েই টার্মগুলো ব্যবহার করেছে। যেমন-‘গণতান্ত্রিক সরকার’, ‘ঐকমত্যের সরকার’, ‘জোট সরকার’, ‘মহাজোট সরকার’। একই সঙ্গে কম আর বেশি উল্লিখিত সরকারগুলো নিজেদের ‘শিক্ষাবান্ধব সরকার’, ‘শিক্ষকবান্ধব সরকার’ ও ‘শিক্ষার্থীবান্ধব সরকার’ বলেও দাবি করেছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতি-পরিবেশ পরিদৃষ্ট হয় মূলত ওই সময় থেকেই। ইত্যবসরে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একে একে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের অশুভ এক প্রতিযোগিতার মনোভাব এসে ভর করে একশ্রেণির স্বার্থপর ব্যক্তির মগজে। দায়িত্বশীল মহলের অপরিণামদর্শিতায় দীর্ঘদিনের নিরলস প্রচেষ্টা ও সাধনার ফলে তিল তিল করে গড়ে ওঠা গোটা ব্যবস্থাটিই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়।