তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড: একটি অবিস্মরণীয় সাক্ষাৎকার
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর শনিবার। রয়টার্স–এর আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এই ছুটির সঙ্গে এক দিন ছুটি বাড়িয়ে আমার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে ঢাকার অদূরে যমুনা রিসোর্ট সেন্টারে অবসর কাটাতে গিয়েছিলাম।
আমরা আমাদের কক্ষে তখন সবাই খোশমেজাজে গল্প করছিলাম। সামনেই টেলিভিশন চলছিল। হঠাৎ একটা সংবাদ চ্যানেলে ‘এই মুহূর্তের খবর’ শিরোনামের দিকে সবার নজর পড়ল।
ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানায় অগ্নিকাণ্ড। অগ্নিকাণ্ডের শুরুর দিকে কত লোকের প্রাণহানি হয়েছে, সেটি বোধগম্য ছিল না।
তবে পরের দিন সেনাবাহিনীর সহায়তায় উদ্ধারকাজ শুরু হলে লাশের স্তূপ হচ্ছিল। মৃত মানুষের সংখ্যা দেখে গোটা জাতি বিস্মিত ও শোকার্ত হয়ে ওঠে।
কমপক্ষে ১১৮ জনের মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করা হয় এবং ১০০–র বেশি লোক আহত হন। বৈদ্যুতিক সংযোগের ত্রুটি থেকে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে বলে প্রথমে ধারণা করা হয়।
তবে জাতির ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণঘাতী অগ্নিকাণ্ড। ২০০৯ সালে ১ হাজার ৬৩০ জন শ্রমিক নিয়ে তাজরীন ফ্যাশনসের যাত্রা শুরু হয়। নৈতিক বিচারে ২০১১ সালের মে মাসে ওয়ালমার্ট এই পোশাক শিল্পকারখানাকে অরেঞ্জ ধাপভুক্ত বলে চিহ্নিত করে যেসব নীতি বেঁধে দেয়, সেগুলো প্রতিপালন না করায় তাজরীন ফ্যাশনসকে ওয়ালমার্ট অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উৎস হিসেবে গণ্য করে এভাবে অরেঞ্জ শ্রেণিভুক্ত করে।
নয়তলা ভবনের নিচতলায় বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ স্তূপ করা ছিল এবং সেখান থেকেই এই আগুনের সূত্রপাত। এ কারণে বিভিন্ন তলায় কর্মরত কয়েক শ শ্রমিক আটকা পড়ে যান। বিভিন্ন তলায় বিপুল পরিমাণে কাপড় ও সুতা স্তূপীকৃত থাকায় দ্রুত এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে ১৭ ঘণ্টারও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। একমাত্র দ্বিতীয়তলায় অন্তত ৬৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়।
অগ্নিকাণ্ডের দ্বিতীয় দিনে তাজরীন ফ্যাশনসের সামনে শত শত মানুষের ভিড়। এই কারখানায় কর্মরত কয়েক শ শ্রমিকের আত্মীয়স্বজনের গগনবিদারী চিৎকার, বিলাপ আর আর্তনাদে সেখানকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। কোনো কোনো মৃতদেহ মারাত্মকভাবে ভস্মীভূত হওয়ায় পরিচয় চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। সে কারণে ওই সব লাশের পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ পরীক্ষার ওপর নির্ভর করতে হয়। আর এ জন্য কাউকে কাউকে ছয় মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
তাজরীন ফ্যাশনসের এই দুর্ঘটনার পর আমি আমার ভ্রমণ বাতিল করে পরের দিন বিশেষ ব্যবস্থায় একাই ঢাকায় ফিরে আসি। অফিসে প্রবেশের পর রয়টার্স-এর ব্যুরো চিফ আনিস আহমেদ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
বললেন, ফলোআপ প্রতিবেদন করতে হবে। এই চিন্তা মাথায় রেখেই আমি ঢাকায় ফিরেছি সে কথা আনিস ভাইকে বললাম। তিনি খুশি হলেন।
তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে ঘটনাক্রমে ফোনে পেয়ে গেলাম। তিনি রয়টার্সকে বললেন, এই দুর্ঘটনার কারণে তাঁর বিপুল পরিমাণ বৈষয়িক ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি তাঁর কারখানায় শ্রমিকদের জন্যও এটি অনেক বড় ক্ষতি বলে উল্লেখ করেন।
তদন্তে দেখা যায়, অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্রের মেয়াদ ২০১২ সালের জুন মাসে শেষ হয়েছে। দায়িত্বে অবহেলাজনিত অপরাধের জন্য ২৮ নভেম্বর কারখানার তিনজন তত্ত্বাবধায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, তাঁরা ভবনের বহির্গমন ফটক তালাবদ্ধ করে রেখেছেন এবং ভবনে অগ্নিকালের ঘটনার পরও শ্রমিকদের বাইরে যেতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অগ্নিকাণ্ড
- তাজরীন ফ্যাশন
- শ্রমিক নিহত