কপ২৯-এ বাংলাদেশের প্রস্তাব প্রসঙ্গে
আজারবাইজানের বাকুতে চলা বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে একদিকে আশা, অন্যদিকে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট মহলের। আশার কথা হচ্ছে, এ সম্মেলনে জলবায়ু ঝুঁকি নিরসনে গঠিত ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’-এ অর্থায়নের পরিমাণ বাড়বে। এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাবে। পাশাপাশি ২০১৪-তে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে ইতিবাচক অবস্থানে আসবে বিশ্ব। অন্যদিকে আশঙ্কা হচ্ছে, বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করতে দায়ী কার্বন নিঃসরণকারী অন্যতম দেশ যুক্তরাষ্ট্রের কার্বন নিঃসরণ কমাতে সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতিবাচক অবস্থান নিয়ে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য এবং সাইডলাইনে বিভিন্ন ফোরামে প্রদত্ত বক্তব্য ও তার অবস্থান বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, জলবায়ু অ্যাকটিভিস্ট, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমগুলোকে আকৃষ্ট করেছে। এবারের সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশের অবস্থানের প্রতি। আপাতদৃষ্টিতে এ সম্মেলনে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ, জলবায়ু অ্যাকটিভিস্ট, নাগরিক সমাজের জন্য ‘অন্যতম অর্জন’। বিশেষ করে পৃথিবীকে জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে ‘শূন্য বর্জ্য ও শূন্য কার্বন’-এর ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন; তাতে তাৎক্ষণিক বিশ্বনেতাদের আকুণ্ঠ সমর্থন এবং এ বক্তব্যের জন্য মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান।
আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে কপ২৯-এর ওয়ার্ল্ড লিডার্স ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতায় প্রধান বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য আমাদের আরেকটি সংস্কৃতি গঠন করতে হবে। একটি ভিন্ন জীবনধারার ওপর ভিত্তি করে আরেকটি পাল্টা সংস্কৃতি গড়তে হবে। এটি হবে শূন্য বর্জ্যের ওপর ভিত্তি করে। এ সংস্কৃতি নিত্যপণ্যের ব্যবহারকে সীমিত করবে, কোনো বর্জ্য অবশিষ্ট রাখবে না।’ এ জীবনযাত্রাও হবে শূন্য কার্বনের ওপর ভিত্তি করে, যেখানে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানি থাকবে না, শুধু নবায়নযোগ্য শক্তি থাকবে। এতে এমন একটি অর্থনীতি হবে, যা প্রাথমিকভাবে সামাজিক ব্যবসার মতো ব্যক্তিগত পর্যায়ে শূন্য মুনাফার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে। সামাজিক ব্যবসাকে সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যা সমাধানের জন্য একটি অলাভজনক ব্যবসা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে তিনি বলেন, সামাজিক ব্যবসার একটি বিশাল অংশ পরিবেশ ও মানবজাতির সুরক্ষায় মনোযোগ দেবে।
অন্যদিকে তিনি বলেছেন, ‘সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের জীবন কেবল সুরক্ষিতই হবে না, গুণগতভাবে উন্নত হবে। এটি যুবকদের জন্য উদ্যোক্তা হওয়ার পথ সহজতর করবে। উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন শিক্ষার মাধ্যমে তরুণরা প্রস্তুত হবে। চাকরিপ্রার্থী তৈরির শিক্ষা উদ্যোক্তাকেন্দ্রিক শিক্ষা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।’ পরিবেশের সুরক্ষার জন্য একটি নতুন জীবনধারার প্রয়োজন, উল্লেখ করে নোবেলে শান্তি পুরস্কার পাওয়া এ অধ্যাপক বলেন, ‘নতুন জীবনধারা চাপিয়ে দেওয়া হবে না, পছন্দ অনুযায়ী বেছে নিতে হবে। তরুণরা সেই জীবনধারাকে পছন্দ হিসেবে বেছে নেবে। প্রতিটি যুবক তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে। এগুলো হচ্ছে শূন্য নেট কার্বন নির্গমন, শুধু সামাজিক ব্যবসা গড়ে তোলার মাধ্যমে শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে পরিণত করার মাধ্যমে শূন্য বেকারত্ব। ‘প্রত্যেক মানুষ তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে উঠবে এবং সারা জীবন তিন শূন্যভিত্তিক ব্যক্তি হিসেবে থাকবে। এটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলবে।’ তিনি বলেন, ‘এটা করতে আমাদের যা করতে হবে, তা হলো এ গ্রহের নিরাপত্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন জীবনধারা গ্রহণ করা, যেখানে সবাই বসবাস করে। আজকের তরুণ প্রজন্ম বাকিটা করবে। তারা তাদের এ গ্রহকে ভালোবাসে।’ ড. ইউনূস বলেন, ‘আশা করি, আপনারা এ স্বপ্ন দেখায় আমার সঙ্গে যোগ দেবেন। আমরা যদি একসঙ্গে স্বপ্ন দেখি, তবে তা সম্ভব হবে।’
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ু সংকট তীব্রতর হচ্ছে এবং সে কারণে মানবসভ্যতা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মানুষ আত্মবিধ্বংসী মূল্যবোধের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আত্মরক্ষাত্মক ও আত্মশক্তিবর্ধক একটি নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক, আর্থিক ও যুবশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আমরা এ গ্রহের মানবসমাজ এই গ্রহের ধ্বংসের কারণ। তিনি বলেন, মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করছে এবং তারা এমন একটি জীবনধারা বেছে নিয়েছে, যা পরিবেশের বিরুদ্ধে কাজ করে। তারা একে একটি অর্থনৈতিক কাঠামো দিয়ে ন্যায্যতা দেয়, যা এই গ্রহব্যবস্থার মতো প্রাকৃতিক হিসেবে বিবেচিত হয়।