পুলিশকে ঢেলে সাজাতে যা যা করা দরকার
শিশুরা সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় পথে দায়িত্বরত পুলিশের সঙ্গে হাসি বিনিময় করছে। হারিয়ে যাওয়া, খুন হওয়া বা সন্দেহজনক কোনো একজন মানুষ সম্পর্কে তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করলে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলার পর্যন্ত পুরস্কারের ঘোষণা ওয়েবসাইট থেকে দেখে আগ্রহীরা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। পুলিশের ওপর জনগণের ভরসা এতটাই প্রকাশ্য ও দীর্ঘস্থায়ী যে এ বিষয়টিই পুলিশের চাকরিকে বেছে নিতে অনেককে উদ্বুদ্ধ করে।
স্কুলের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে মাসের একটি দুপুরে স্কুলে পুলিশের কয়েকজন সদস্য আসেন, যাঁদের সঙ্গে শিক্ষার্থীরা মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেয় ও সাইবার বুলিংসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। টানা কয়েক বছরের জরিপে দেখা গেছে, স্কুলশিক্ষক, রাজনীতিবিদ, এমনকি কখনো কখনো পরিবারের সদস্যদের চেয়েও পুলিশের ওপর মানুষের বেশি আস্থা।
এ চিত্রগুলো আমাদের দেশের জন্য এখনো বাস্তব না হলেও পৃথিবীর অনেক দেশের জন্যই এগুলো পরিচিত দৃশ্য। এই চমৎকার উদাহরণগুলো জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, কানাডা, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে পুলিশের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততার বাস্তব চিত্র। আমাদের দেশে তাহলে জনবান্ধব পুলিশের দেখা পাওয়া এবং পুলিশ ও জনগণের একই সঙ্গে কাজ করার ঘটনা কেন বিরল?
মূলত বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে পুলিশভীতি ও পুলিশের সঙ্গে জনবিচ্ছিন্নতার শুরু। পরে এটা উপমহাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে গত ১০০ বছরের রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এবং বাংলাদেশে গত প্রায় দুই দশকের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মধ্য দিয়ে। ফলে শিশু থেকে বৃদ্ধ, কারও মনে পুলিশ শব্দটি কোনো নিরাপত্তা ও ভরসার অনুভূতি তৈরি করে না। পুলিশ সংস্কার তাই এখন সময়ের দাবি।
সরকার এটি উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে ইতিমধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু পুলিশের টেকসই সংস্কারের জন্য একটি স্থায়ী পুলিশ কমিশন প্রয়োজন। সম্প্রতি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্সের (এসআইপিজি) উদ্যোগে আয়োজিত একটি আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, পুলিশের প্রতিনিধি, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষার্থীদের বক্তব্যে এ দাবিই অনুরণিত হয়েছে।
এসআইপিজি পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ২০১৫ সাল থেকে পুলিশের প্রতি জনগণের বিশ্বাস তীব্রভাবে হ্রাস পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির সাম্প্রতিক জরিপ ন্যাশনাল সার্ভে অন দ্য সিটিজেনস এক্সপেকটেশনস ফ্রম দ্য ইন্টেরিম গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ ২০২৪ বলছে, পুলিশের ওপর মাত্র ১১ শতাংশ মানুষের আস্থা আছে।
নিঃসন্দেহে এ ফলাফল জনগণের কাছে যেমন কাম্য নয়, পুলিশের কাছেও স্বস্তিকর হওয়ার কথা নয়। স্থায়ী পুলিশ কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পুলিশকে জনমুখী করার আবশ্যকতা এখানেই। ব্রিটিশ আমলে গঠিত পুলিশের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ব্রিটিশ শাসকদের শাসনকে পাকাপোক্ত করা। সেই থেকে প্রায় একই আইনি কাঠামোতে চলছে আমাদের পুলিশ। ২০০৭ সালে একবার সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এ সংস্কার বিভিন্ন রাজনৈতিক অসহযোগিতার কারণে আলোর মুখ দেখেনি।
পুলিশ কমিশনে কারা থাকবেন, কারা এর সদস্য হবেন—এগুলো নির্ধারণের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করা জরুরি। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে অন্যান্য সরকারি কমিশনের সদস্য কারা হবেন, তা নির্ধারণ করার জন্য সার্চ কমিটি গঠনের উদাহরণ রয়েছে।
জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মতো পুলিশ কমিশনকে একটি স্বাধীন কমিশন হতে হবে। এই কমিশনের প্রধান কাজ হবে পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি এবং শৃঙ্খলা তদারকি করা। এই কমিশনে একজন কমিশনপ্রধান যিনি হতে পারেন সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি। তাঁর নেতৃত্বে যাঁরা থাকতে পারেন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি, মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধি, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের প্রতিনিধি, পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি।