
ব্যাংক সংস্কারে দরকার রাজনৈতিক অর্থনীতির সম্মিলিত সিদ্ধান্ত
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার প্রায় তিন মাস পূর্তি হতে চলল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সরকারের কাছে দেশ ও জনগণের প্রত্যাশা অনেক। দেশের মানুষ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংস্কার চাইছে। বিগত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের শাসনামলের প্রায় ১৬ বছর ধরে আর্থিক খাতে সীমাহীন লুটপাট সাধিত হয়েছে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক লুটেরা সিন্ডিকেট জনগণের অর্থ শুধু লুটপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। শুধু অর্থনীতিই নয়, বিগত সরকার ধ্বংস করেছে এ দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ প্রতিটি খাত। দীর্ঘকালের গণতন্ত্রহীন সমাজে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এ দেশের অর্থনীতিতেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থা এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংক খাত। দেশে বর্তমানে প্রায় ৬২টি বাণিজ্যিক ব্যাংক সচল রয়েছে। প্রচলিত ও ইসলামী ঘরানার এসব বাণিজ্যিক ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের তফসিলভুক্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সার্বিক নিয়ন্ত্রণ করলেও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগও এসব ব্যাংকের অন্যতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের চলমান যৌথ তদারকি সত্ত্বেও ব্যাংক খাতের সীমাহীন দুর্দশার জন্য দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নই মূলত দায়ী। এসবের বাইরে আইন-আদালতের দুর্বলতা এবং ফাঁকফোকরও অন্যতম নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। আইনগত দুর্বলতার কথা এজন্য আসছে যে দেশে প্রচলিত ধারার ব্যাংকের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের জন্য আলাদা আইন নেই। আলাদা আইন না থাকলেও ইসলামী ব্যাংক প্রচলিত ধারার ব্যাংকের চেয়ে আলাদা এবং অতিরিক্ত সুবিধা পেত। প্রচলিত ব্যাংকের জন্য বিধিবদ্ধ তারল্য হার ১৭ শতাংশ হলেও ইসলামী ব্যাংকের জন্য তা ছিল সাকল্যে সাড়ে ৯ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক শরিয়াহ বিধিবিধান অনুযায়ী তাদের আমানত ও বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম সম্পাদন করবে—এ মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেও সেসব ব্যাংক তা আক্ষরিক অর্থে প্রতিপালন করত কিনা তদারকি সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ কেউই সে দায়িত্ব পালন করেনি। প্রতিটি ইসলামী ব্যাংকে পৃথক শরিয়াহ বোর্ড থাকলেও তাদের কার্যক্রমে কখনই স্বাতন্ত্র্যবোধ দেখা যায়নি। বরং ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ড ব্যাংকের দুষ্কৃতকারী ম্যানেজার ও মালিক পক্ষের তল্পিবাহক এবং সহযোগী হিসেবেই কাজ করেছে। বর্তমানে দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর বর্ণনাতীত তারল্য সংকটের জন্য নিজ নিজ ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ডকেও দায়ী করতে হবে। কারণ ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য শরিয়াহ বোর্ডের মতামতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কথা। সে যে কারণেই হোক না কেন এ দেশের ব্যাংক খাতকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তোলা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে।