ব্যাঙের ছাতা ও ব্যাংকের ছাতা
বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ব্যাংকগুলোতে অর্থ লুটপাটের কাহিনি কারো অজানা নয়। প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা লুট করে, পুঁটি মাছের প্রাণ হরণ করে, সমাজের রুই-কাতলা এত দিন থেকেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে বর্তমান সরকার আসার পর এবং বিশেষত নবনিযুক্ত গভর্নরের সদিচ্ছায় তাদের গরু খোঁজা হচ্ছে বলে খবর পাচ্ছি। সব ব্যাংকের ছাতা হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক এরই মধ্যে গৃহীত কিছু পদক্ষেপে তার ছাপ প্রতীয়মান হয়ে ওঠে।
এর আগেও পত্রপত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনার অভাব ছিল না, অভাব ছিল শুধু বাধা দূরীকরণে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির।
প্রসঙ্গত বলে নেওয়া বোধ করি ভালো, চীন দেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত একটি প্রবাদ হচ্ছে এ রকম—বড় ধরনের ডাকাতরা ব্যাংক স্থাপন করে।
দুই.
হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের একটি বিখ্যাত উক্তির মর্মার্থ স্মরণ করা যেতে পারে—রিকশা চালিয়ে উপার্জন করলে মানুষ দেখে ফেলবে, মান-ইজ্জতের বালাই থাকবে না, তার চেয়ে অন্ধকারে চুরি করা অনেক ভালো, কেউ দেখবে না। উপার্জন হবে, কিন্তু মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে না।
বর্তমান বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে যে হরিলুট চলছে, তাতে ‘বহুব্রীহি’ নাটকের এই উক্তিটি বারবার মনে পড়ে। ব্যাংকের সবাইকে অন্ধকারে রেখে অন্ধকার পথে ডাকাতি করে বড় হওয়ার বাসনা বড় বড় লোকের; দিনের আলোতে ছোটখাটো মানহানিকর। তাঁরা সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি, সংসদ সদস্য। তাঁদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে আকুলতা সবার।
নানা বাহানায় বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েই চলত। বর্তমানে প্রায় ৬০টি ব্যাংক কাজ করছে এবং শোনা কথা, কয়েক মাস আগেও ডজনখানেক অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল। কোনো রাখঢাক না রেখে ব্যাংকের সংখ্যাবৃদ্ধির পক্ষে বেশ জোরেশোরে সাফাই গাইতেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রীরা। আপত্তি থাকার কথাও নয়, কারণ যাঁরা অনুমোদন পাচ্ছেন, তাঁদের প্রায় সবাই সরকারের সমর্থক, কিন্তু মুশকিল হয় যখন সরকারের স্বার্থ ও দেশের স্বার্থ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত ব্যাংক যে কত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে তার বড় প্রমাণ তদানীন্তন ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি।
তারপর একে একে নিভছিল দেউটি—সোনালী, জনতা, এমনকি অগ্রণী, ন্যাশনাল ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ইত্যাদি। ব্যাংকগুলোতে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকল্পে স্বয়ং সরকার উদগ্রীব ছিল বলে এন্তার অভিযোগ রয়েছে। আর এসব ঘটত অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখের সামনে। অথচ তারা অর্থবাজারের অভিভাবক দাবিদার। বাংলাদেশ ব্যাংক মুখে কুলুপ এঁটে মনে মনে গাইত, ‘আমার বলার কিছু ছিল না, না গো...চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...’।
তিন.
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিরুপাক্ষ পাল থেকে ধার করা বক্তব্য দিয়ে মূল আলোচনায় যাওয়া যেতে পারে। স্যার আইজাক নিউটন নাকি একবার দরজায় বড় একটি গর্ত খুঁড়েছিলেন তাঁর বিড়ালটি আসা-যাওয়ার জন্য। এগুলোকে বলে পেট ডোরস বা পোষা প্রাণীর দরজা। সাধারণত দরজার নিচে দিয়ে রাস্তা। এই দরজায় তিনি আবার অন্য একটি ছোট গর্ত খোঁড়েন বিড়ালছানা আসা-যাওয়ার জন্য। আমরা নিশ্চিত নই সত্যি সত্যি নিউটন ওই কাজটি করেছিলেন কি না, তবে এই রূপক থেকে একটি শিক্ষা বেরিয়ে আসে। তা হলো এই যে বড় বিড়াল ও বিড়ালছানা যদি একই গর্ত দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারে, তাহলে ছোট গর্তটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। তেমনি আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয় যদি ব্যাংকিং খাতের সব দেখাশোনা করতে পারে, তাহলে আলাদা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাখার কোনো যুক্তি আছে কি? বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিরুপাক্ষ পালের সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতামতকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অফিসের এক কোণে বাংলাদেশ ব্যাংককে জায়গা দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। এটি শুধু ব্যয়সাশ্রয়ী হবে না, এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার আপাত প্রতীয়মান দূরত্বকে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে সক্ষম হবে বলে আমাদের ধারণা।
দুর্ভাগ্য আমাদের, বাংলাদেশের ব্যাংকিং বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কথাই যেন সরকার শুনতে আগ্রহী নয়। সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় যা করছে বা করে, তা অর্থনৈতিক বিবেচনা পুষ্ট নয়। যেমন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া কিংবা বন্দুকের মুখে একটি দক্ষ ব্যাংক কোনো লুটেরা গোষ্ঠীর হাতে ন্যস্ত করা। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের কাছে ‘গুড বয়’ ইমেজ খাড়া করতে গিয়ে বাজারবহির্ভূত অসংগতিগুলোকে গিলতে বাধ্য হচ্ছে; যেমন—নতুন ব্যাংকের জন্ম ও ব্যাংক প্রশাসনে পরিবারতন্ত্রের পুনর্জন্ম ইত্যাদি।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এবং তার সঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের তিন মাস অতিক্রান্ত হতে চলল, এখনো ‘এক কম্বল মে দো পীর’ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংকিং ডিভিশন নিয়ে ‘সমালোচিত’ সমস্যার সমাধান হয়নি।