রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ প্রশ্নের মীমাংসা কীভাবে হবে
৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পরই সরকার গঠনের ধরন ও কাঠামো নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। নতুন সরকার কার কাছে শপথ নেবে? এক পক্ষ মনে করেছিল, যে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র–জনতা অভ্যুত্থানে বিজয় লাভ করেছে, সেই সরকারের রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন সরকারের শপথ নেওয়া ঠিক হবে না। আন্দোলনে বিজয়ীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখ লাখ মানুষকে সাক্ষী রেখে শপথ নেবেন।
অপর পক্ষ মনে করল, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ নেওয়াই সমীচীন হবে। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার বঙ্গভবনে তাঁর কাছেই শপথ নিল। সরকার গঠনে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামানও ভূমিকা রাখেন। তিনিই প্রথম আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। সংবাদ সম্মেলন করে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন।
সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদের ১ উপধারায় আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে যদি (ক) তিনি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন অথবা (খ) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন।’ একই অনুচ্ছেদের ৩ উপধারায় আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর যেহেতু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন, সেহেতু তাঁর পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়াটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়; কিন্তু ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবিটি যে সামনে এল, এর মীমাংসা কীভাবে হবে?
সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে আছে, ‘রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করিবেন।’
প্রশ্ন উঠতে পারে, স্পিকার তো পদত্যাগ করেছেন। সংবিধান মানলে নতুন স্পিকার নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনিই স্পিকারের দায়িত্ব পালন করবেন। পদত্যাগ করুন আর সংসদ ভেঙে যাক, যা–ই হোক না কেন। নব্বইয়ের গণ–অভ্যুত্থানের পর পঞ্চম সংসদের সূচনা অধিবেশনে (৫ এপ্রিল ১৯৯১) এরশাদ আমলের স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরী সভাপতিত্ব করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ধার করে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা।’ এরশাদের পতনের পরপরই চতুর্থ সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা থাকা না-থাকার বিষয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার ভিত্তিতেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কিন্তু আমরা যতটা জানতে পেরেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের দাবি ওঠার পর বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের তিন নেতা প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন। দলটি এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায় না।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবি মানতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। পাঁচ দফার দ্বিতীয় দাবি ছিল ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা, যা ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার পূরণ করেছে।
স্বাভাবিক সময়ে আমাদের রাষ্ট্রপতিদের তেমন কাজ থাকে না। সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদের ৩ উপধারা অনুযায়ী, ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত সবকিছু রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ