বাঙালির গুজব কিন্তু ফেলনা নয়
হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি বলছেন, খেয়াল করেছেন, আমরা বলি—আসেন গল্পগুজব করি? মানে আমরা গল্প আর গুজবকে সমার্থক বলে মনে করি। আর কোনো ভাষায় তো এমন বলে না। ইংরেজরা কি বলে স্টোরি অ্যান্ড গসিপ? বাঙালির গুজবপ্রিয়তা নিয়ে একটা ঠাট্টাই করেছিলেন বোধ হয় হুমায়ূন আহমেদ। নাকি বিদ্রূপ? কিন্তু সাবধান। বাঙালির গুজবপ্রীতি নিয়ে ঠাট্টা করার আগে দুবার ভাবতে হবে।
ইদানীং বেস্টসেলার লেখক ইউভাল নোয়া হারারি তো গুজবকে মানবজাতির উন্নতির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। বলছেন যে গুজব শুরু হওয়ার পরেই মানুষ দুনিয়া শাসন করা শুরু করে। হারারি গুজবকে অনেক উঁচুতে জায়গা দেন। গুজবের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুনিয়াকে জানাবোঝার এক বিশাল বিপ্লব ঘটে যায়। এর আগপর্যন্ত মানুষ অন্য সব জানোয়ারের মতোই ছিল। সে ছোট জন্তু–জানোয়ার মেরে খেয়ে ফেলত। আর বড় জানোয়ার খেত মানুষকে।
এমনকি মানুষের ভাষা গড়ে ওঠার পেছনেও গুজবের ভূমিকা আছে। মানুষ সমাজের ভেতরেই বাঁচে। আদিমকালে জঙ্গলের ভেতরে কোথায় বাঘ, সিংহ, হরিণ আছে তা জানলেই চলত না। নিজের দলের মধ্যে কে কেমন, কে কাকে অপছন্দ করে, কার ওপর আস্থা রাখা যায়—এসব তথ্যও দরকার হতো। আজকেও হয়।
মনে করুন, আপনার কাজের জায়গায় সব মিলিয়ে ৫০ জন মানুষের সঙ্গে আপনাকে ওঠাবসা করতে হয়। সেই হিসাবে ১ হাজার ২২৫টা পারস্পরিক সম্পর্ক থাকবে সেখানে। আর কে কোন পরিবার থেকে এসেছে, কোথায় পড়ালেখা করেছে, কার বিশ্বাস কী রকম—সেসব মিলিয়ে আরও অজস্র সামাজিক ব্যাপার। এগুলো সামলানোর একটা বড় উপায় হলো গুজব। গুজব নিয়ে হারারি ভাবনাটা ধার করেছেন আরেকজন পণ্ডিতের কাছ থেকে। এই মূল চিন্তাটা রবিন ডানবার নামের একজন নৃতাত্ত্বিকের। ১৯৯৮ সালে ডানবার একটা বই লেখেন। বইয়ের নাম গ্রুমিং, গসিপ অ্যান্ড দ৵ ইভল্যুশন অব ল্যাঙ্গুয়েজ। বইটা বাংলায় অনুবাদও করা হয়েছে।
প্রাণিজগতের মধ্যে সবচেয়ে বড় মগজ মানুষের। এই মানুষ কিনা দিন-রাত ছোট ছোট জিনিস নিয়ে বকবক করে সময় নষ্ট করে! ডানবার বললেন যে এই ছোট কথাগুলো, মানে এই গুজবের একটা বড় ভূমিকা আছে মানুষের উন্নতির পেছনে। বানর, শিম্পাঞ্জি এসব প্রাণী অন্য প্রাণীর চেয়ে সামাজিক। এরা অবসর সময়ে একে অপরের গায়ের পোকা বেছে দেয়। এই পোকা বাছার মানে হলো, আমি তোমার ভালোমন্দের খেয়াল রাখি।
আদিমকালে মানুষ তো থাকত বড় বড় দলে। একেক দলে দেড়-দুই শ মানুষ। এরা একে অপরের পোকা বাছাবাছি করতে গেলে অর্ধেক জীবন শেষ হয়ে যাবে। রীতিমতো অসম্ভব এক কাজ। এরই বিকল্প হিসেবে মানুষ ভাষা গড়ে তুলেছে। নিজের দলের অন্য মানুষদের ভালোমন্দের খোঁজখবর রাখার জন্য একজনের কাছে আরেকজনের খবর নেওয়া। আর আরেকজন মানুষ যখন অন্য কারোর খবর দেয়, তখন সে সেখানে নিজের মত প্রকাশ করে। সেটি আবার যাকে নিয়ে কথা, তাকে জানতে দিতে চায় না। ডানবারের মতে, গুজব আর ভাষা আসলে একই সঙ্গে গড়ে উঠেছে।
তবে সমস্যা হয়ে গেল তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এসে। ফেসবুকে মানুষ আলাপ করে; কিন্তু সেখানে মানুষ থাকে না। থাকে মানুষের একটা আরোপিত চরিত্র। আসল মানুষ নিজেকে রাখে লুকিয়ে। আর এ জন্যই প্রতিদিন অজস্র অডিও–ভিডিও ফাঁস হওয়ার কাণ্ডে এত আগ্রহ নিয়ে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাস্তব দুনিয়া এখানে ছায়ার মতো হয়ে থাকে। সেই ছায়ার জগতে তলোয়ার ঘোরানোর আনন্দই অন্য রকম। তাই বোধ হয় আমাদের দেশে প্রতিদিন নতুন চাঞ্চল্যকর বিষয় হাজির হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেসবের আয়ু হয় বড়জোর এক দিন।
ফেসবুকের যুগে গুজব হঠাৎ করে মানী–গুণী ব্যক্তির অবস্থা বেহাল করে দিতে পারে। আবার বড় পর্যায়ে কেবল গুজবের কারণে মানুষের ধন–প্রাণ খোয়াতে হয়।