রোগীকে খারাপ সংবাদ দেওয়ার কায়দা-কানুন

বিডি নিউজ ২৪ মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম প্রকাশিত: ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৭:৫৬

বাবা তখন বেঁচে ছিলেন। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটি ছিল খানিকটা বিখ্যাত কার্টুন সিরিজের চরিত্র ‘টম অ্যান্ড জেরি’র মতো। আমি কোনো বিষয়ে মতামত দিলেই সেটা এক বাক্যে না করে দিতেন। না করে দেওয়াই যৌক্তিক মনে করতেন। পেশায় সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। তো একদিন মা ফোন দিয়ে জানালেন বাবার পা ফুলে গেছে। ডায়াবেটিসের পরিমাণও অনেক বেশি। আমি তৎক্ষণাৎ বাবাকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলি। তিনি কোনো মতেই রাজি হলেন না। তার বদ্ধমূল ধারণা জটিল কিছু হয়নি। হোমিওপ্যাথি কিংবা কিছু গাছগাছড়ার ওষুধ খেলেই ভালো হয়ে যাবেন তিনি। সেভাবেই এলাকার এক কবিরাজ ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকের পারামর্শে পথ্য নিতে থাকলেন।


এর মাঝে পার হয়ে যায় প্রায় দুই মাসের মতো। এদিকে মা ও আমার দুশ্চিন্তা বাড়ছে ক্রমেই। কারণ একই সঙ্গে পা ফোলা ও ডায়াবেটিস বৃদ্ধি। কয়েকজন ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করলাম। তারা সবাই অনুমান করলেন কিডনি রোগজনিত সমস্যা বাবার শরীরে বাসা বেঁধেছে। রাজশাহীর বিখ্যাত কয়েকজন চিকিৎসকের হদিসও দিলেন তারা। এই তালিকা থেকে একজন চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্টও নিলাম। একরকম জোর করে বাবাকে নিয়ে গেলাম সেই চিকিৎসকের কাছে। দেশ সেরা কিডনি বিশেষজ্ঞদের একজন তিনি। বেশ ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন তিনি। নিজ চেয়ারে আরাম করে বসে কলিংবেলে চাপ দিলেন সহকারীকে পরবর্তী রোগীকে পাঠানোর জন্য। পরবর্তী রোগী ও তার আত্মীয় বসলেন পেছনের চেয়ারে। এদিকে বাবা আর আমি একে অপরের দিকে চোখে চোখ রেখে বোঝার চেষ্টা করিছি ডাক্তার আসলে কী রোগ নির্ণয় করলেন। ডাক্তার আমার কাছে সরাসরি জানতে চাইলেন পেশাগতভাবে আমার বাবা কী করেন। আমি কী করি। আমি বললাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। আমার জবাব শোনা মাত্রই তিনি ক্ষেপে উঠলেন। বেশ ক্ষোভসহকারে বললেন, ‘এতো দেরি করেছ কেন? তোমার বাবার দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। একেবারেই শেষ পর্যায়ে।’


ডাক্তারের এই কথা শুনে বাবা ও আমি দুজনেই স্তব্ধ। আমাদের মুখে কোনো কথা নেই। বাবা আমার দিকে আড়চোখে তাকালেন। আমিও বাবার দিকে তাকিয়ে যেন তাকে শেষবারের মতো দেখে নিলাম। অনুভব করলাম যেন এক ধরনের শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে শিরদাঁড়া দিয়ে। আমার সেই শীতল শিহরণ অনুভব করি আজও প্রতি পলে প্রতি ক্ষণে। আর বাবার সেই চাহনির মানে আমার হৃদয়ে ও অন্তরে বিঁধে আছে আজও। বাবার সেই চাহনির মানে ছিলো পরাজয়ের। হেরে যাওয়ার। এই প্রথম তিনি হেরে গেলেন নিজের যুক্তির কাছে। তার সন্তানের যুক্তি ও আবেগের কাছে, মানে আমার কাছে। কারণ সন্তানের কথা শুনে আর কয়েকটা দিন আগে চিকিৎসা নিতে রাজি হলে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকত। ডাক্তারের চেম্বারে পিতা-পুত্রের শরীর যখন রোগীর আসন থেকে উঠতে চাইছে না, ডাক্তার তখন মনোযোগ দিলেন পরবর্তী রোগীর দিকে।



যা হোক, কোনো ব্যক্তির শরীরে জটিল রোগ ভর করলেই তিনি হারিয়ে ফেলেন নিজের পরিচয়সত্তা, জীবন ও পরিপার্শ্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ। নিজেকে বলতে থাকেন ‘আমিই কেন? মানে, এই রোগটি আমারই কেন হলো?’ এরপর ডাক্তারের চেম্বারে গেলে তার মনোজগৎজুড়ে চলতে থাকে আশা-নিরাশা ও অনিশ্চয়তার দোলাচল; জেঁকে বসে জীবন, মরন ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভয় ও দুশ্চিন্তা; শারীরিক বেদনাবোধ ও মানসিক চাপ; একাকিত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধ, অপরাধ ও লজ্জাবোধ, রোগমুক্তি ও কৃতজ্ঞতাবোধ। এমন মনে হয় যেন সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা, অসহায়ত্ব গ্রাস করে। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকবার আগ মূহুর্তে তিনি ভাবতে থাকেন ডাক্তার কী বলবেন; কী রোগ নির্ণয় করবেন; চিকিৎসা পরিকল্পনা কী হবে; আদতে তিনি আরোগ্য লাভ করবেন কি-না। ক্রমেই রোগের শারীরিক লক্ষণগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। রোগ ও তার লক্ষণগুলোর কোনটি ডাক্তারকে বলবেন আর কোনটি বলবেন না, তার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। স্মরণ করতে থাকেন আগে কোনো ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতাটি কেমন ছিল। ডাক্তারের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হয় না। সময় যেন থেমে থাকে। নিজের বেদনা, অস্বস্তি ও লক্ষণগুলো পর্যালোচনা করে নিজেই নির্ণয়ের চেষ্টা করেন রোগটিকে। চিন্তা ভর করে ডাক্তারের পরামর্শ ফি, পরীক্ষা-নীরিক্ষা, ও ওষুধের খরচের পরিমাণ। ভাবতে থাকেন নিজ জীবন, পরিবার, সন্তান, কর্মস্থল ও উপার্জনের ওপর এই রোগ কী প্রভাব ফেলবে। বন্ধুবান্ধব ও সমাজ তার এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি কীভাবে দেখবে। ভাবতে থাকেন এই ডাক্তার আসলেই সঠিক ও আন্তরিকভাবে চিকিৎসা করছেন কি-না; চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ে সক্ষম কি-না। নিজ জীবন ও মৃত্যুর প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের ওপর আস্থা রাখা যায় কি-না। কোনো কোনো রোগী এক ধরনের আত্মগ্লানি ও লজ্জাবোধে ভুগতে থাকেন। রোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য নিজেকে দায়ী করতে থাকেন। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কা জেঁকে বসে মনজুড়ে। হাসপাতাল, চিকিৎক, চিকিৎসা ব্যবস্থা ও পরিবারের লোকজনের ওপর রাগ, ক্ষোভ ও হতাশা দানা বেধে ওঠে মনে।


ডাক্তারের চেম্বার ও হাসপাতাল তার কাছে একদম নতুন পরিবেশ। এখানকার মানুষগুলো ও তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, আচরণ ও মূল্যবোধ সবই তার কাছে নতুন, অচেনা ও অজানা। কাজেই নতুন পরিস্থিতি ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হিমশিম খান তিনি। বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তবে এ সমস্ত কিছু ভিন্ন হয় ব্যক্তিভেদে, রোগীর আর্থ-সামাজিক অবস্থাভেদে, রোগের তীব্রতাভেদে, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অতীত অভিজ্ঞতা ভেদে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের পরিবেশ, আবহ, অপেক্ষা কক্ষ, স্বাস্থ্য সহায়ককর্মী ও ডাক্তারের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ও যোগাযোগ রোগীর এসব মনোজাগতিক ক্রিয়া-বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। আর রোগীর এসব আবেগ, অনুভূতি ও উপলব্ধির প্রশ্নে ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবাকর্মীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, তাদের যোগাযোগ দক্ষতা। এই দক্ষতা রোগীর প্রতি সদয় ও বিবেচনাপূর্ণ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে ভূমিকা পালন করে। কাজেই একজন ডাক্তারকে কেবল রোগের চিকিৎসা করলেই চলে না। বরং চিকিৎসা করতে হয় সেই ব্যক্তির যার শরীরে কোনো রোগ বাসা বেঁধেছে। কেননা প্রত্যেক রোগীর আছে স্বাস্থ্য সম্পর্কে তার নিজস্ব বিশ্বাস ও বোধ। রোগ ও চিকিৎসা সম্পর্কে নিজস্ব তত্ত্ব। তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগৎও এই বোধ ও তত্ত্বকে প্রভাবিত করে ব্যপক মাত্রায়। প্রতিটি রোগীর অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবেলার সক্ষমতা ভিন্ন। প্রত্যেক রোগী তার রোগ, পথ্য ও কর্তব্য সম্পর্কে তথ্য তথ্য-চাহিদা আলাদা। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে ওষুধ সেবন ও জীবন যাপনের রোগী ভেদে ভিন্ন হয়। প্রতিটি রোগীর শারীরিক ও মানসিক চাপ মোকাবেলার ধরন ভিন্ন। কাজেই একজন ডাক্তারকে চিকিৎসা ও তথ্য দিতে হয় প্রত্যেক রোগীর আলাদা আলাদা শারীরিক-মানসিক ও সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে। দিতে হয় আবেগীয় সমর্থন ও সমানুভূতি। রোগীকে তার নিজস্ব গল্প বলতে দিতে উৎসাহিত করতে হয়। শুনতে হয় সমস্ত কথা পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে। সৃষ্টি করতে হয় এমন একটি আবহ যাতে রোগী মন খুলে কথা বলতে পারে। নির্ভয়ে প্রকাশ করতে পারে সমস্ত ভয়, আশঙ্কা ও সমস্যা।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও