রাষ্ট্রব্যবস্থাই কি শাসনতন্ত্রের শেষ গন্তব্য
বর্তমানে সারা পৃথিবীব্যাপী চলমান অরাজক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিদ্যমান। সকল রাষ্ট্রই জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিলেও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে অনেক রাষ্ট্র নিজেরাই দুনিয়ায় বিভিন্ন জায়গায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা জোট শুধু অন্যদেশ বা জোটের সঙ্গেই যুদ্ধে লিপ্ত নয় বরং অনেক দেশের অভ্যন্তরেই জাতিগত বা ধর্মীয় সংঘাতে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। এমতাবস্থায়, মানবাধিকার রক্ষায় এবং মানুষের সর্বজনীন কল্যাণে রাষ্ট্রব্যবস্থার সফলতা, ব্যর্থতা এবং এই ব্যবস্থার গন্তব্য নিয়ে আলোচনা জরুরি।
আজ আমরা যে রাষ্ট্রব্যবস্থা দুনিয়াব্যাপী দেখতে পাচ্ছি, সেটা একদিনে তৈরি হয়নি। হাজার বছরের রাজনৈতিক বিবর্তনের সর্বশেষ অবস্থা হলো আজকের এই আধুনিক রাষ্ট্রের স্বরূপ। দুনিয়াজোড়া ১৯৫টি স্বাধীন দেশ ১৯৫ রকমের ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তা তৈরি করেছে। এই ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তার ধারণা শক্তিশালী হয়েছে জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা থেকে। প্রাচীন আমল থেকেই সীমিত আকারে জাতীয়তাবাদ, জাতীয়তাবোধ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলেও, ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এবং সার্বভৌমত্বের ধারণা শক্তিশালী হয় ১৬৪৮ সালে যখন; ইউরোপে প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক চার্চ প্রায় তিনশ বছরব্যাপী ধর্মযুদ্ধের পর একে অপরের সঙ্গে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। ঐতিহাসিকভাবে এই চুক্তিটি ‘ট্রিটি অব ওয়েস্টফেলিয়া’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মূল বিষয় হলো, একে অপরের ভূমির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে সংশ্লিষ্ট শাসকশ্রেণি চূড়ান্তভাবে তার ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারবে। রাষ্ট্রে বা ভূখণ্ডে যুদ্ধাবস্থা ছাড়া রাষ্ট্রের এই ক্ষমতাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। এক কথায়, রাষ্ট্রের ক্ষমতা হলো চরম এবং চূড়ান্ত। এই ধারণাই রাষ্ট্রের বা ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব হিসেবে পরিচিতি পায়।
ইউরোপে সতেরো শতকে আবির্ভূত হওয়া এই জাতীয়তাবাদী ধারণা তারা প্রথমে তত্ত্বগতভাবে গ্রহণ করে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও গ্রহণ ও প্রয়োগ করে। এই তত্ত্বের সফল বাস্তবায়নের চূড়ান্ত রূপ হলো আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব। ১৬৪৮ সালে স্বাক্ষরিত ওয়েস্টফেলিয়া চুক্তির ফলে ইউরোপে ব্যাপকভিত্তিক ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটে। যদিও; মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, দীর্ঘ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, ধর্ম, রীতিনীতি এবং সমষ্টিগত মূল্যবোধ হলো জাতীয়তাবাদ ও জাতীয়তাবোধের মূল উপাদান বা ভিত্তি। কিন্তু, ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তাবাদে এই উপাদান এবং ভিত্তির চেয়েও রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সীমানার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। যদিও অনেক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জাতিগত নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়, ধর্ম বা সংস্কৃতি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। অনেক ক্ষেত্রে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণার কারণে নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তাসমূহ, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো নিগ্রহের শিকার হয়েছে, কোথাও আবার চিরতরে বিনাশ হয়েছে। এখনো দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় বিরোধ, জাতিগত বিরোধ, রাষ্ট্রের সীমানা নিয়ে বিরোধসহ নানা বিরোধ চলমান।
ইউরোপে জন্ম নেওয়া এই জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা পরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতীয়তাবাদী নেতারা ধার করে নিয়ে আসেন বা ইউরোপীয়দের প্ররোচনায় স্থানীয়ভাবে এই ধ্যান-ধারণার রাজনৈতিক প্রয়োগ ঘটান। ফলস্বরূপ, বিভিন্ন উপনিবেশ এবং সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে অনেকগুলো নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।
বর্তমান দুনিয়ায় বা বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্র যেমন শক্তিশালী হয়েছে তেমনি রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার মধ্যে অনেক নতুন উপকরণ যোগ হয়েছে। যেমন আইন, শাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি। মানুষ রাষ্ট্র এবং জাতীয়তার ধারণা তৈরি করেছে ঠিকই, কিন্তু কিছুকাল পরে মানুষ আবার বুঝতে পেরেছে, শুধু নিজের রাষ্ট্রের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেই তার উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। বিভিন্ন কারণেই বিশেষ করে, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং নিজের সৃষ্টি করা জ্ঞান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে না পারলে কোথায় যেন অপূর্ণতা থেকেই যায়। তাই রাষ্ট্রসমূহ রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকেই অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছে।
বর্তমান রাষ্ট্র এবং বিশ্বব্যবস্থায় ‘বিশ্বায়ন’ অন্যতম শক্তিশালী তত্ত্ব। এই তত্ত্বটিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রয়োগ করেছে মূলত নিজেদের পুঁজির বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণের মাধ্যমে মুনাফাকে সর্বোচ্চভাবে বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে, গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নিজের সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দ্বন্দ্ব
- সংঘাত
- অরাজকতা
- রাষ্ট্রব্যবস্থা