শিক্ষিত জনগণ ছাড়া শাসকশ্রেণির চরিত্র বদলায় না
দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীর শ্রেণি-চরিত্র সবসময় প্রায় একই রকমের হয়ে থাকে। সেটা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হোক কিংবা অগণতান্ত্রিক সরকার হোক, তাতে শ্রেণিচরিত্রের খুব একটা পার্থক্য থাকে না। এর প্রধান কারণ জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। অনেক সময় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা শাসকশ্রেণিকে নিরঙ্কুশভাবে স্বৈরাচারী করে তোলে। একইভাবে তারা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার বলয়ে থেকে নিরঙ্কুশ দুর্নীতিগ্রস্তও হয়ে ওঠে। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও নিরঙ্কুশ দুর্নীতির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিক লর্ড অ্যাকটনের (১৮৮৭) একটি উক্তি এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। তার মতে, ‘পাওয়ার টেন্ড্স টু করাপ্ট, অ্যান্ড অ্যাবসলিউট পাওয়ার করাপ্ট্স অ্যাবসলিউটলি।’ বর্তমানকালে বিভিন্ন দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে এ উক্তির যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারকেও কখনো কখনো জনগণের সঙ্গে অগণতান্ত্রিক ও নিবর্তনমূলক আচরণ করতে দেখা যায়। অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ উপায়ে যে সরকারব্যবস্থা কায়েম হয়, সেই সরকারের কাছ থেকে দেশের জনগণ কখনোই গণতান্ত্রিক ও কল্যাণমূলক আচরণ আশা করতে পারে না। সুশিক্ষিত ও সচেতন নাগরিকশ্রেণির নিষ্ক্রিয়তায় স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নির্বাচিত সরকারও অনেক সময় ধীরে ধীরে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী আচরণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। অবশ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয়, সেই সরকারও যে জনগণের সঙ্গে সবসময় গণতান্ত্রিক ও উদার আচরণ করবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা এর অন্যতম কারণ। এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে রাষ্ট্রে সরকারপ্রধানের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগে ‘ভারসাম্য নীতি’ প্রতিষ্ঠা জরুরি। বিশেষ করে মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকারব্যবস্থায় সরকারপ্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে আলঙ্কারিক রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। সংবিধানের মাধ্যমেই এর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্যহীনতার প্রভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী একচেটিয়াভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে নিজেকে স্বৈরাচারী শাসক হিসাবে পরিণত করেন।
যেসব দেশে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সরকার নির্বাচিত হয়, সেসব দেশে ওই সরকার ক্ষমতা প্রয়োগের শুরু থেকেই জনগণের ওপর কর্তৃত্ববাদী ও নিবর্তনমূলক আচরণের প্রয়োগ করতে থাকে। এ ধরনের সরকার জনগণকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নানা অজুহাতে ধরপাকড় করে জোরজবরদস্তিমূলকভাবে ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ দীর্ঘ করতে থাকে। এটাই অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ সরকারের শ্রেণিচরিত্র।
অপরদিকে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উভয় শ্রেণির জনগণের এক বিরাট অংশের মধ্যেও বিভাজনের ধারা লক্ষ করা যায়। এর একটি অংশের বৈশিষ্ট্য হলো অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারকে সার্বিক সমর্থনের মাধ্যমে নিজের সুবিধাটুকু বাগিয়ে নেওয়া, আর আরেকটি অংশের বৈশিষ্ট্য হলো সরকারের সমালোচনার মাধ্যমে সব ক্ষেত্রে সরকারকে অসহযোগিতা করা। তবে সরকারকে অসহযোগিতা করার জন্য যে ধরনের জনবান্ধব বিরোধী রাজনৈতিক দল দেশে উপস্থিত থাকা দরকার, বাস্তবে সে রকম রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে অগণতান্ত্রিক সরকার আরও বেশি মাত্রায় স্বৈরাচারী ও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এ ধরনের স্বৈরাচারী সরকার সরকারের বিরুদ্ধে ন্যূনতম সমালোচনাও উদারচিত্তে মেনে নিতে পারে না। ফলে ওই স্বৈরাচারী সরকার নিজের ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘ করার লক্ষ্য নিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ শাসন করতে থাকে। এ ধরনের সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় যেসব প্রতিষ্ঠানের সমর্থন ও সহযোগিতা অপরিহার্য, সেসব প্রতিষ্ঠানকে নানা কায়দাকানুন করে নিজেদের বশে নিয়ে আসে। বিরোধী মত দমন এবং গুম-খুন হয়ে ওঠে এ সরকারের প্রায় নিত্য অনুষঙ্গ। এর ফলে প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী সরকার একচেটিয়াভাবে দেশ শাসন করতে থাকে এবং এ কারণে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে। প্রতিটি দেশে দুর্বল বিরোধী রাজনৈতিক দল থাকা বা শক্তিশালী ও জনবান্ধব বিরোধী রাজনৈতিক দল না থাকার সুযোগে অগণতান্ত্রিক সরকার সব ক্ষেত্রে নিজেদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অপ্রতিরোধ্য বলে ধরে নেয়। একপর্যায়ে পুরো দেশকে ভয়ের সংস্কৃতির সাম্রাজ্য হিসাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা চালায়। নানা ধরনের প্রলোভন ও ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে প্রায় সব গণমাধ্যমকে অবলীলায় কব্জা করে ফেলে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশও বিভাজিত হয়। একদল স্বার্থান্বেষী বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়, যারা ক্রমাগতভাবে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারকে অসংকোচে সমর্থন ও সহযোগিতা করতে থাকে। শাসকগোষ্ঠীও এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের নানা রকমের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের আয়ত্তে রাখে। দেশে সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক তৈরির দায়িত্ব যে শিক্ষকদের, সেই শিক্ষকশ্রেণির একটা অংশও সুবিধাবাদীদের দলের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেয়। এর ফলে রাষ্ট্র থেকে সাধারণ মানের বিচারবিবেচনাবোধসম্পন্ন লোকেরা নির্বাসনে চলে যায়; উচ্চমানের বিচারবিবেচনাবোধ তো রাষ্ট্রের কাছ থেকে আশাই করা যায় না। এ পরিস্থিতিকে অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী সরকার নিজেদের সাফল্য বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। আর বশীভূত প্রচারমাধ্যম ব্যবহার করে নিজের প্রচার-প্রচারণা বাধাহীনভাবে চালিয়ে যায়। এটাই স্বৈরাচারী সরকারের বৈশিষ্ট্য।
স্বার্থান্বেষী শাসকগোষ্ঠী ও নমনীয় বিরোধী রাজনৈতিক দল, উভয়ের শ্রেণি-চরিত্র অনেক ক্ষেত্রে প্রায় একই রকমের হয়ে থাকে। কী সরকার, কী বিরোধী দল, কোনো পক্ষই দেশের জনমনোভাব অনুধাবন করার চেষ্টা করে না। অন্য কথায়, উভয় পক্ষই জন-আকাঙ্ক্ষা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়। ফলে তাদের উভয়ই জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে ভিন্নপথে ক্ষমতার সিংহাসনে আসীনকাল প্রলম্বিত করে বা ক্ষমতায় আরোহণের নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে থাকে। একদিকে শাসকগোষ্ঠী তার অনুগত রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধী দলের ওপর নিবর্তন চালায়, অপরদিকে বিরোধী দল দলীয় বাহিনী নিয়ে রাষ্ট্রে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। বাস্তবে এসব ঘটনার সঙ্গে দেশের জনগণের তেমন কোনো কার্যকর সম্পর্ক থাকে না। পরিতাপের বিষয়, এ ধরনের পরিস্থিতিতে জনগণকে একপ্রকার বাধ্য হয়ে অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের অপশাসন মেনে নিতে হয়। একই সঙ্গে তাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জনবিচ্ছিন্ন সরকার ধরে নেয় তারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে; তাই তাদের শাসন জনগণকে মানতে হবে। অথচ অপশাসনের কারণে শাসকগোষ্ঠী যে ধীরে ধীরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, সেটাও অনুধাবন করতে পারে না। কিন্তু রাজনীতি পাঠের শেষ অধ্যায়ে এসে যখন তারা জনবিচ্ছিন্নতার দিকটি অনুধাবন করে, তখন আর তাদের পক্ষে কিছুই করার থাকে না।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শাসক
- গণতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদ