চীনের ‘মেগা-ড্যাম’ নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমেও ঢেউ তুলেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে– দিল্লির বিরুদ্ধে ‘পানি অস্ত্র’ ব্যবহারে তিব্বতের ‘সাংপো’ নদীতে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বেইজিং। ‘মাদার অব অল ড্যামস’ নামের ৬০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি শুকনো মৌসুমে যেমন ভারতের সুপেয় পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিতে পারে, তেমনই বর্ষা মৌসুমে আকস্মিক বন্যা ঠেলে দিতে পারে ভাটির দিকে। গালওয়ান-পরবর্তী সময়ে বহুমাত্রিক যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন দিল্লি তাই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে অরুণাচলের ‘সিয়াং’ নদীতে ১১ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রস্তাব করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুকনো মৌসুমের জন্য ৯ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধরে রাখা সম্ভব হবে। আর বর্ষায় আকস্মিক বন্যা ঠেকাতেও ‘বাফার জোন’ হিসেবে কাজ করবে। (ইউরেশিয়ান টাইমস, ১৫ অক্টোবর ২০২৪)।
কথা হচ্ছে, তিব্বতের সাংপো কিংবা অরুণাচলের সিয়াং আমাদেরই ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা। আর্থসামাজিক ও প্রতিবেশগত দিক থেকেও এই নদী চীন বা ভারতে চেয়ে বাংলাদেশের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সীমান্তের বাইরে থেকে যে প্রবাহ বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তার ৬৫ শতাংশই আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে (সিএনএ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড সল্যুশন, ২০১৬, ওয়াশিংটন ডিসি, যুক্তরাষ্ট্র)। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ব্রহ্মপুত্র নিয়ে আমাদের উদ্বেগ যেন সবচেয়ে কম।
এটি ঠিক, ব্রহ্মপুত্রে এখনও কোনো ব্যারাজ নেই। আর যেভাবে ‘ব্যারাজ’ পানি প্রত্যাহার করে থাকে, সেভাবে ‘ড্যাম’ পানি প্রত্যাহার করে না; প্রবাহের চক্রায়নের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে মাত্র। সেজন্য কেউ কেউ বলে থাকেন, ড্যাম হলে ভাটির দেশের ক্ষতি নেই। কিন্তু বাস্তবে ড্যামের কারণে স্থানীয়ভাবে নির্মাণকারী দেশের আর্থসামাজিক ক্ষতি তো হয়ই; ভাটির অন্য দেশেরও অন্তত দুই ধরনের ক্ষতি হয়।
প্রথমত, প্রতিটি ড্যামের জলাধারে প্রবাহ আটকে রাখার কারণে, এমনকি জলাধারবিহীন ‘রান অব রিভার’ ড্যামের ক্ষেত্রেও অন্তত ৫ শতাংশ বেশি পানি বাষ্পীভবন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, নদীর প্রবাহ মানে নিছক পানি নয়। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে ‘সিল্ট’ বা তলানিপ্রবাহ। এই তলানিপ্রবাহই মূলত নদীর প্রতিবেশ ব্যবস্থা, কাঠামোগত ভারসাম্য, পুষ্টি, ভূমি গঠন প্রক্রিয়া ঠিক রাখে। ড্যামের কারণে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পানি নেমে আসে বটে, আটকে যায় সিল্ট বা তলানিপ্রবাহ, যেটা বাংলায় ‘পলি’ হিসেবে বহুলপরিচিত। ফলে ড্যামের ভাটিতে যেসব বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে, তার মধ্যে রয়েছে নদীর কাঠামোগত ভারসাম্য বিনষ্ট বা ভাঙন বৃদ্ধি, মৎস্যসম্পদের পুষ্টির অভাব, ভূমি গঠন প্রক্রিয়ায় বাধা।
চীনের ড্যামের ক্ষেত্রেও প্রতিবেশ ও পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব নিশ্চয়ই আছে। সেটি নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ কম ছিল ‘কূটনৈতিক কারণে’। ২০১৭ সালের আগস্টে ‘দ্য হেগ ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল জাস্টিস’ থেকে প্রকাশিত ‘ট্রান্সবাউন্ডারি ওয়াটার কো-অপারেশন ওভার দ্য ব্রহ্মপুত্র রিভার: লিগ্যাল, পলিটিক্যাল ইকোনমি অ্যানালাইসিস অব কারেন্ট অ্যান্ড ফিউচার পটেনশিয়াল কো-অপারেশন’ শীর্ষক সমীক্ষাতেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল।
ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনা তৎপরতা নিয়ে ভারত যতটা উদ্বিগ্ন, বাংলাদেশ ততটা নয়। কারণ বাংলাদেশি একজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, শুকনো মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় চীনের অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ। অবশ্য ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা যদিও এই অঙ্কের সঙ্গে দ্বিমত করেন, তাদের হিসাবেও সেটি ২৫ শতাংশের বেশি নয়। যদি ২৫ শতাংশও হয়, সেটি বাংলাদেশের জন্য বড় অঙ্ক নয়। কারণ চীনা ড্যামের জলাধার যদি আকস্মিকভাবে ছেড়েও দেওয়া হয়, দূরত্বের কারণে সেটি বাংলাদেশ পৌঁছতে পৌঁছতে বিরূপ প্রভাব হবে নগণ্য। ওই সমীক্ষায় একজন বিশেষজ্ঞ হিসাব কষে দেখিয়েছেন, তিব্বত থেকে ছেড়ে দেওয়া ১০ ফুট উচ্চতার প্রবাহ বাংলাদেশ পৌঁছতে পৌঁছতে ৩ ইঞ্চিতে নেমে আসতে পারে।
এটিও ঠিক, আমাদের ব্রহ্মপুত্রে মূল প্রবাহ আসে অরুণাচল ও আসামের বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল থেকে; কারণ তিব্বতে বৃষ্টিপাত হয় না। কিন্তু চীনা ড্যাম নিয়ে ভাটির দেশ হিসেবে নির্লিপ্ততা কি ভারতের হাতে আরেকটি ড্যাম নির্মাণে উৎসাহী করে তুলছে না?
এটিও ঠিক, ব্রহ্মপুত্রের মূল প্রবাহের পাশাপাশি অরুণাচলে প্রবাহিত সুবনসিড়ির মতো উপনদীগুলো থেকেও পানি আসে। ওইসব নদীতে ভারত যেসব ড্যাম নির্মাণ করছে বাংলাদেশের জন্য সেগুলোও চিন্তার বিষয়। একই কারণে ব্রহ্মপুত্রের অরুণাচল অংশ বা ‘সিয়াং’ নদীতে প্রস্তাবিত মেগা-ড্যামও বাংলাদেশের জন্য বেশি চিন্তার। এখন, চীনা ড্যামের গোদ নিয়ে নির্লিপ্ত থাকতে থাকতে গোদের ওপর যুক্ত হচ্ছে ভারতীয় ড্যামের বিষফোড়া।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
- বাঁধ নির্মান