যেসব পদক্ষেপ ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়
যেসব কারণে জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। কাজেই এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো চাল, ভোজ্যতেল, ডিম, মুরগি, চিনি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য আরও বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি হ্রাসে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যক পণ্যের চাহিদা টাকার সরবরাহের ওপর ততটা নির্ভর করে না বলে এভাবে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ জন্য বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপের প্রয়োজন।
এরই মধ্যে বাজার তদারক করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার। এ ছাড়া কয়েকটি পণ্যের শুল্ক-কর কমানো হয়েছে। এগুলো দরকারি পদক্ষেপ; কিন্তু যথেষ্ট নয়। নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির কার্যকর ও টেকসই সমাধানের জন্য আরও কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
‘অদৃশ্য হাতের’ কারসাজি বন্ধ করতে হবে
বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম নির্ধারিত হওয়ার কথা চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে বাজারের ‘অদৃশ্য হাতের’ মাধ্যমে। বাংলাদেশে ‘অদৃশ্য হাতের’ নির্দেশে পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয় ঠিকই; কিন্তু সেই অদৃশ্য হাতটা অনেক ক্ষেত্রে বাজারের নয়, কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর। দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত উভয় ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই তা সত্যি।
উদাহরণস্বরূপ, দেশে উৎপাদিত পণ্য মুরগি ও ডিমের দাম নির্ধারণের বিষয়টি খতিয়ে দেখা যাক। মুরগি আর ডিম বিক্রি করেন হাজার হাজার মানুষ। কিন্তু মুরগি আর ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অল্প কয়েকটি বৃহৎ করপোরেট কোম্পানি। এই কোম্পানিগুলো পোলট্রি খাদ্য ও মুরগির বাচ্চার সিংহভাগ উৎপাদন করে, সেই সঙ্গে মুরগির ডিম ও মাংসের বাজারের বড় একটি অংশ তাদের দখলে।
নিজেরা উৎপাদনের পাশাপাশি চুক্তি ভিত্তিতে অনেক খামারিকে মুরগি পালনের কাজে লাগাচ্ছে কোম্পানিগুলো। এভাবে মুরগির খাদ্য, বাচ্চা, ডিম ও মাংস উৎপাদনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের মাধ্যমে গোটা পোলট্রি খাতের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে কোম্পানিগুলো। ফলে কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো মুরগির খাদ্য, বাচ্চা, ডিম ও মাংস উৎপাদনের পরিমাণ ও মূল্য হ্রাস–বৃদ্ধি করতে পারে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসব কোম্পানির কাছে হিসাব চাইতে হবে মুরগির বাচ্চা, পোলট্রি ফিড, ডিম আর মুরগি উৎপাদনে তাদের প্রকৃত খরচ কত আর কত টাকা দরে তারা এগুলো বাজারে বিক্রি করে। এদের দেওয়া হিসাব যাচাই–বাছাই করতে হবে, প্রয়োজনে অডিট করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রান্তিক খামারি ও ভোক্তাদের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালার মাধ্যমে পোলট্রিশিল্পে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে যেন মুরগির খাদ্য, বাচ্চা, ডিম, মাংস উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ গুটিকয় কোম্পানির হাতে থাকতে না পারে। এ ছাড়া পোলট্রিসহ পশুখাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামাল যেমন ভুট্টা, সয়াবিন মিল ইত্যাদিতে আমদানিনির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে, যেন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে দেশীয় বাজারে অস্থিরতা তৈরি করা না যায়।
শুধু দেশে উৎপাদিত নিত্যপণ্যই নয়, বিগত সরকারের আমলে নিত্যপণ্যের আমদানির নিয়ন্ত্রণও চলে গিয়েছিল হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে। তারা বাজারের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিযোগিতার বদলে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পণ্য আমদানির প্রতিটি পর্যায়ে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিবিসি বাংলার এক অনুসন্ধান অনুসারে, বেশি পরিমাণে পণ্য আমদানি করা প্রতিষ্ঠানগুলো একজোট হয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা নিজের ইচ্ছেমতো পণ্য কিনতে পারেন না। একজন ব্যবসায়ী যদি কোনো পণ্য ক্রয় করতে চান, তাহলে তাঁকে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে যেতে হবে, তখন সেই বড় ব্যবসায়ীই ঠিক করে দেবেন যে কোন পণ্য কত দামে কার কাছ থেকে কিনতে হবে। এতে রাজি না হয়ে ব্যবসায়ী ব্যক্তিটি যদি মনে করেন তিনি নিজেই পণ্যটি আমদানি করবেন, তাহলে দেখা যাবে ব্যাংক তাঁর এলসি খুলতে রাজি হচ্ছে না, কাস্টমস-ভ্যাটসহ নানা দপ্তর থেকে বাধা আসছে, এমনকি আমদানি করা পণ্য বড় জাহাজ থেকে খালাস করে বন্দরে আনার জন্য লাইটার ভেসেল পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি এই সব বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি যদি কোনোভাবে পণ্যটি আমদানি করেও ফেলেন, দেখা যাবে বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাঁর আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামে বাজারে পণ্যটি ছেড়ে দিয়ে তাঁকে লোকসানের মুখে ফেলে দেবে। (পণ্য আমদানি থেকে বিক্রি, কীভাবে সব নিয়ন্ত্রণ করছে সিন্ডিকেট, বিবিসি বাংলা, ১২ আগস্ট ২০২৩)
- ট্যাগ:
- মতামত
- বাজার নিয়ন্ত্রণ