রাজনৈতিক দলগুলো ও পুরোনো প্রজন্ম কি এই বিপ্লবের গভীরতা বুঝতে পারছে
বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা একটি স্বৈরাচারী ও নিষ্ঠুর সরকারকে পরিবর্তন করতে রক্তাক্ত বিপ্লব করেছে। এই বিপ্লব ছিল বৃদ্ধ, শিশু, যুবক, ধনী, দরিদ্র, রিকশাচালক, কারখানার শ্রমিক—সবার। সবাই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, জীবন দিয়েছেন এবং জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁরা দৃঢ়সংকল্প নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেক মানুষ শহীদ হয়েছেন। শহীদদের কথা জাতি কখনো ভুলবে না। তাঁদের কাহিনি ভবিষ্যৎ স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকে থাকবে।
যেমন আন্দোলনে থাকা অবস্থায় এক নারী শিক্ষার্থী বলেছিলেন, ‘আমি আর ফিরে যাব না। আমার পেছনে পুলিশ আর সামনে বিজয়। হয় মরব, নয়তো জিতব।’ অথবা বিপ্লবে অংশ নিতে যাওয়ার আগে স্কুলছাত্র শহীদ আনাসের মাকে লেখা চিঠি। খাতায় লেখা প্রতিটি অক্ষর যেন একটি একটি প্রতিবাদ। পুলিশের গুলিতে সে শহীদ হয়। জাতি কখনো ভুলবে না। জাতির জন্য এরাই চেতনা হয়ে থাকবে যুগ যুগ ধরে। অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে জাতির এই অমূল্য স্বাধীনতা অতীত স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। আল্লাহ তাঁদের সর্বোচ্চ জান্নাত দান করুন, তাঁদের আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক।
রাজনৈতিক দলগুলো কি এই বিপ্লবের গভীরতা বুঝতে পারছে? যদি তারা বুঝত, তবে নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে হাস্যকর সম্মেলন ডাকত না। তাদের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল নতুন জাতি গঠনের জন্য তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করা। তা না করে তারা নতুন জাতির স্বপ্ন থেকে অনেক দূরে সরে থাকল। সত্য কথা বলতে গেলে তারা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দেউলিয়া হয়ে আছে। এই বিপ্লব বাংলাদেশের সাত কোটি তরুণের স্বপ্ন, যারা বিপ্লবের বোঝা একাই বহন করেছিল। পুরোনো দলগুলোর এতে কোনো দরকার ছিল না। নতুন বাংলাদেশের জন্য পুরোনো রাজনীতি যে অকেজো, তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, এটি মেটামর্ডানিস্ট দর্শনের নেতৃত্বে ডিজিটাল যুগের বিপ্লব। অতীত যুগের চিন্তাবিদেরা বা নেতারা এখানে কীভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারেন। ড. ইউনূস যথার্থই বলেছেন, ‘এখন নতুন প্রজন্মের যুগ।’
এই স্বাধীনতার মানে কী? আগের গণ–অভ্যুত্থান বা গণআন্দোলনের সময় সরকার পরিবর্তন হয়েছে মাত্র কিন্তু কাঠামোগত পরিবর্তন হয়নি। ফলে সরকার দেশ শাসন করার জন্য ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণের পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। পরবর্তী সরকারগুলো দেশকে নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ, শোষণ এবং পরাধীন করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ নিয়মের দাসত্বে পরিণত করে। এই দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজব্যবস্থা মানুষের মানসিকতা, অনুভূতি ও জীবনধারাকে কলুষিত করেছে। ফলে গড়ে ওঠে একটি অনৈতিক ফ্যাসিবাদ সমাজ, যার বিষয়বস্তু হলো দমন-পীড়ন দ্বারা শাসন ও শোষণ। এর ফলে মানুষ সর্বস্তরে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি (৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪) যমুনা টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, সব চাঁদাবাজির কেন্দ্র আওয়ামী লীগকে হটিয়ে এখন বিএনপির প্রতিনিধিরা দখল করে নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কারওয়ান বাজার, আন্তনগর পরিবহন, ফেরিঘাট, এমনকি বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও রেহাই পায়নি। বিএনপি নেতাদের উচিত ছিল নিজে গিয়ে জোর করে দখল করা অফিসগুলোর দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া। দল থেকে চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোথাও কোথাও ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা যথেষ্ট নয় আমরা দেখতেই পাচ্ছি। পুরোপুরি সেটি বন্ধ করা গেলে সেটি হতো রাজনীতিতে বিশাল একটি প্যারাডাইম শিফট। রাজনীতিবিদদের মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার জন্য রাজনীতি এখন আর নেই, এখন রাজনীতি ছাত্রজনতার। সমাজে এখন দুটি আদর্শ—একটি ক্ষয়িষ্ণু ফ্যাসিবাদের অন্যটি বর্ধিষ্ণু সাম্যতা ও নৈতিকতার। আপনার পথ কোনটা? ফ্যাসিবাদী সমর্থিত দুর্নীতির প্রতিষ্ঠান আর থাকবে না।
যেসব জনগণ ও দল দুর্নীতিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে, তাদের উচিত দুর্নীতিমুক্ত নতুন সমাজ গঠনের সংকল্পকে গুরুত্ব দেওয়া। তাদের অবশ্যই নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে এবং আইনি উপায়ে তাদের ক্ষমতা এবং অর্থ বাড়ানোর দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। মনোভাবের এই পরিবর্তন আরেকটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন (প্যারাডাইম শিফট)।
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক দল
- বিপ্লব
- গণঅভ্যুত্থান