পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে...
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন, ‘যুগের ধর্ম এই-পীড়ন করিলে সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!শোনো মর্ত্যের জীব! অন্যেরে যত করিবে পীড়ন, নিজে হবে তত ক্লীব!’ কবিতার এ লাইন কটি মনে পড়ল ১৪ বছর আগের একটি ভিডিও ক্লিপ দেখে। মনে পড়ল সেদিনের কথা, যেদিন প্রায় ৪০ বছর ধরে বসবাস করা বাড়িটি তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বিএনপির চেয়ারপারসন এবং জাতীয় সংসদে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।
সেনানিবাসের সেই বাড়ি থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়েছিল অত্যন্ত রূঢ় ও অসম্মানজনকভাবে; যেটাকে কেউই ভালোভাবে নেননি।১৩ নভেম্বর ২০১০। আগের দিনই লোকমুখে প্রচারিত হয়েছিল, যেকোনো সময় খালেদা জিয়াকে তাঁর বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
বাড়িসংক্রান্ত মামলাটি তখনো পুরোপুরি নিষ্পত্তি হয়নি। আপিল বিভাগের রায় হওয়ার পরে খালেদা জিয়ার রিভিউ মামলা করার সুযোগ ছিল। তাই সবার মনেই বিশ্বাস ছিল, সরকার অন্তত মামলার চূড়ান্ত রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। কিন্তু তা করা হয়নি, এমনকি ওই দিন সকালে প্রখ্যাত আইনজীবী (বর্তমানে মরহুম) ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করা হবে না বলে তারা আশ্বস্ত হয়েছেন। অর্থাৎ, বিচারপতি খায়রুল হক আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশ্বাস মিথ্যা প্রমাণিত হয়। দুপুরেই নিরাপত্তাবাহিনী বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে। বাড়িতে থাকা জিনিসপত্রের খুব সামান্যই তিনি নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। একরকম জোর করে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়।
৪০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে প্রায় সর্বহারা হয়ে বেরিয়ে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদে দুবারের বিরোধীদলীয় নেতা গুলশানে তাঁর রাজনৈতিক কার্যালয়ে ওঠেন। রাত কাটান তাঁর ছোট ভাইয়ের বাসায়। সেদিন গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, তিনি বাড়ির জন্য কেঁদেছেন। এ রকম মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আমি নিজেও বিস্মিত হয়েছিলাম ম্যাডামের কান্না দেখে।
কেননা, দীর্ঘদিন দূর এবং কাছ থেকে দেখে তাঁকে অত্যন্ত শক্ত মনের একজন মানুষ বলেই আমার ধারণা জন্মেছিল। রাজনীতি কিংবা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে এসে ব্যক্তিগত দুঃখের কথা জনসমক্ষে প্রচার করে তাঁকে কখনো আবেগাপ্লুত হতে দেখিনি। কিংবা কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজের কষ্টের কথা বলে জনগণের সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টাও তিনি কখনো করেননি। জনসমক্ষে তিনবার দেশবাসী খালেদা জিয়াকে কাঁদতে দেখেছে।
২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ান-ইলেভেন সরকারের জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বিএসএমএমইউ (পিজি) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পুত্র তারেক রহমানকে দেখতে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন মা খালেদা জিয়া। দ্বিতীয়বার কেঁদেছিলেন অপমানজনকভাবে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পর ২০১০ সালে। আর তৃতীয়বার কেঁদেছিলেন ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নাড়িছেঁড়া ধন ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর লাশ জড়িয়ে ধরে। চোখের সামনে জওয়ান ছেলের নিথর দেহ দেখা একজন মায়ের জন্য কতটা দুঃসহ, তা বলে বোঝানোর দরকার পড়ে না।
আসলে খালেদা জিয়া ওই দিন বাড়ি হারানোর জন্য কাঁদেননি। তিনি তো জানতেন বাড়িটি সরকার তাঁকে বসবাস করতে দিয়েছে। ইচ্ছে করলে সরকার তা ফেরত নিতে পারে। তাঁকে যতটুকু জানি, তিনি বাড়ির জন্য নয়, কেঁদেছিলেন অসম্মানজনকভাবে তাঁকে বের করে দেওয়ার কষ্টে। যে রকম অপমানজনক পদ্ধতিতে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন খালেদা জিয়া তা মেনে নিতে পারেননি।
আর সেটাই ছিল তাঁর মর্মপীড়ার কারণ। চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিনের সংসারের মালামাল রেখে আমাকে আজ এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে হলো। বেডরুমের দরজা ভেঙে রীতিমতো টেনেহিঁচড়ে তারা আমাকে বের করে দিয়েছে।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কার কাছে বিচার চাইব? এর বিচারের ভার আমি আল্লাহ ও দেশবাসীর ওপর ছেড়ে দিলাম।’
খালেদা জিয়ার সেদিনের সেই কান্না হৃদয় স্পর্শ করেনি—এমন মানুষ খুব কমই আছে। অনেকেই বলেছিলেন, ওই বাড়িতে খালেদা জিয়ার বসবাস যদি আইনানুগ না-ও হয়ে থাকে, তবু স্বেচ্ছায় বাড়িটি ছাড়ার জন্য তাঁকে আরও সময় দেওয়া যেত। বিশেষত ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের আশ্বাসের পর, যেটা তিনি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের বরাতে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়া নিশ্চিন্ত ছিলেন, তাঁকে সেদিন উচ্ছেদ করা হবে না, হয়তো আরও সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই সময় তাঁকে দেওয়া দূরের কথা, নিজের ব্যবহার্য সামগ্রী পর্যন্ত আনতে দেওয়া হয়নি। সেনা পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সেদিন খালেদা জিয়া এতটুকু সম্মান-সহানুভূতি পাননি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কাছ থেকে। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হওয়া সত্ত্বেও সরকার তাঁর মর্যাদার দিকে তাকায়নি।