মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাই বড় কাজ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ এখনো এক মাস পূর্ণ হতে দশ দিন বাকি। একটি পূর্ণমেয়াদি সরকারের বেলাতেও এ সময়টুকু খুব একটা আমলে নেওয়ার মতো নয়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসন শেষে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মানুষ যেন তাদের পুরো তৃষ্ণা ১৫ দিনের মধ্যেই মেটাতে চাইছে। এমনকি যে মানুষটিকে তিন তিনটি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, সে-ও চাইছে ওই আওয়ামী কর্মীর বিচার আগে হোক। সে হয়তো অনুমান করতেই পারছে না, গত ১৫ বছরে শাসকগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতি, সামাজিক বন্ধন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতিচর্চাকে কতটা তলানিতে নিয়ে গেছে। আর ওই ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষটিকেই আপনি দোষারোপ করবেন কীভাবে বা কেন? সে তো অর্থ পাচার বোঝে না, ব্যাংক লুট বোঝে না। জানার মধ্যে এটুকুই জানত, পাঁচ বছর পরপর ভোটের মাধ্যমে ক্ষতাসীনদের পরিবর্তন করা যায়। পেটে ভাত পড়ুক আর না পড়ুক, ভোট প্রদানের ক্ষমতা তার আছে। তিনি গত ১৫ বছরে একমাত্র সম্বল ভোটাধিকারটুকুও হারিয়েছেন। এরকম কোটি কোটি মানুষের ক্ষোভ থেকেই তো আগস্ট অভ্যুত্থানের জন্ম।
কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়দায়িত্বকে খুব সাধারণ অর্থে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, এ স্বৈরশাসনের পতন কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের আন্দোলন কিংবা দাবির ফসল নয়। এটি সম্পূর্ণভাবে ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষার রক্তাক্ত ফলাফল। এ আকাঙ্ক্ষাকে সামনে নিয়েই পথ চলতে হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। আর এ আকাঙ্ক্ষাই সার্বিক সরকারি ব্যবস্থাপনাকে ভাবিয়ে তুলবে। শিক্ষার্থীরা একটি বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করতে চাচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন একটি সামাজিক বিপ্লব; পুরো শাসনব্যবস্থাকে আমূল পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু আমাদের আগস্ট অভ্যুত্থান কেবল শাসকের পতন ঘটিয়েছে, শাসনব্যবস্থার নয়। সুতরাং, তত্ত্বগতভাবে এখানে একটি ফারাক থেকেই যাবে। তবে সাধারণ অর্থে শিক্ষার্থীদের ‘স্পিরিট’টা হলো একটি ধনবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যেন একটি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সুশাসন বলতে মানুষের নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা, যা গত ১৫ বছরে ধ্বংস করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়োগেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। দুজন শিক্ষার্থী বাদে সব উপদেষ্টাই তাদের পেশাগত জীবনে অত্যন্ত সফল এবং রাজনৈতিকভাবে ‘দলকানা’ যাদের বলি, তাদের কেউ নন। বিগত দিনে স্ব-স্ব পেশায় অত্যন্ত দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের দ্বারা সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার একটি উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। তবে তা সময়সাপেক্ষ বিষয়। আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হবে। তলিয়ে পড়া বাংলাদেশকে আবারও একটি গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসার কাজটি খুব সহজ নয়।
গত দেড় দশকে মানুষের মৌলিক অধিকারের বাইরে দেশের আর্থিক খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অর্থ পাচার হয়েছে প্রায় ৯ লাখ কোটি টাকা, ঋণখেলাপির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অর্থ লুট করা হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা (সরকারি হিসাবে ও গবেষকদের মতে ৪ লাখ কোটি টাকা) আর ২০২৪ সালে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১০টি দেশের তালিকায় ‘সমহিমায়’ অবস্থান। বর্তমান সময়ে পরিকল্পনা উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। অত্যন্ত অভিজ্ঞ এ অর্থনীতিবিদ দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই বলেছেন, তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখতে হবে। বিগত সময়ে উন্নয়নের নামে অনেক অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। আমরা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের প্রতি আস্থা রাখতে চাই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে দীর্ঘদিন অত্যন্ত দক্ষতা ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে দেখেছি। দেশের এ সংকটময় মুহূর্তে তার কাছ থেকে আশাজাগানিয়া কিছু প্রত্যাশা করতেই পারি। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ হয়ে উঠেছিল। মুদ্রানীতি প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজস্ব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির গভর্নর নিযুক্ত হয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। এতে করে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে প্রবাসীদের আস্থা কিছুটা হলেও ফিরেছে। বিগত সরকারের সময়ে আমাদের গড় রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল প্রতি মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা কম। আর সরকার পতনের ফলে আগস্ট মাসের ২৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় প্রায় ৪৬ শতাংশ বেশি। সুতরাং, শুরুটা নিরাশাজনক নয়।