সংস্কার : রাষ্ট্র পরিচালনা ও ক্ষমতা কাঠামো
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে দেশ একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছে। দেশে পরিবর্তন এসেছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। এ পরিবর্তনকে আরও মহিমান্বিত করা যেত, যদি শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, কিছু মানুষের কারণে ক্ষমতার পালাবদলের পর অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যই বর্তমানে ক্ষমতাসীন হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। প্রত্যাশা পূরণের জন্য প্রায়োজন ব্যাপক সংস্কার সাধন।
সংস্কার নিঃসন্দেহে একটি কঠিন কাজ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলছে, তারা ইতোমধ্যে তা শুরু করেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগোচরেই চলছে মাঠ দখলের পালা। চলছে হুমকি, পদত্যাগ, অব্যাহতি এবং নতুন পদায়ন। এরকম কাজ আগেও হয়েছে এবং ফলাফল শেষ পর্যন্ত শূন্যই থেকে গেছে। জনগণ ভেবেছিল, এবারের বিষয়গুলো মনে হয় অন্যরকম হবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো নজির স্থাপিত হয়নি।
সংস্কারের জন্য কিছু পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু অমুকের পদত্যাগ বা তমুকের নিয়োগ চাই, এ ধরনের কাজ কি সংস্কারের অংশ হতে পারে? মানুষ ভাবছে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ইচ্ছা করে বা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরকম কাজ করছে বা করাচ্ছে। যদি কাউকে কোনো পদ থেকে অপসারণের প্রয়োজন হয়, তাহলে সে কাজটি এ সরকারই অনায়াসে করতে পারে। যেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবেই অযোগ্য বা অসৎ লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব, সেখানে জোরাজুরি বা অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করার কি কোনো প্রয়োজন আছে?
সংস্কারের অর্থ শুধু শুদ্ধি অভিযান নয়। সংস্কারের অর্থ হচ্ছে পদ্ধতিগত পরিবর্তন-সংশোধন বা সংযোজন। অনেকেই সংস্কার নিয়ে ‘স্বল্পমেয়াদি’, ‘দীর্ঘমেয়াদি’ ইত্যাদি নানা কথা বলছে। সরকার যেভাবেই সংস্কার করুক না কেন, একথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে, কেন বারবার শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন হয়। কেন কিছু লোক অশুদ্ধ হয়। কেন কিছু লোক তোষামোদি করে এবং কীভাবে তোষামোদকারীরা অবৈধ সম্পদ অর্জন করে।
আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা এমন যে, ক্ষমতাসীন সরকার ইচ্ছা করলেই কাউকে পুরস্কৃত বা শাস্তি প্রদান করতে পারে। রাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা-কর্র্মচারী ইচ্ছা করলেই কাউকে সুবিধা প্রদান বা হয়রানি করতে পারে। ইচ্ছাধীন এ ব্যবস্থাই হচ্ছে সর্বনাশের মূল। এটি ব্যবহার করেই সরকার রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এটি ব্যবহার করে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জনগণকে বঞ্চিত করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করে।
সরকারের জবাবদিহিতা এবং কর্মের মূল্যায়ন পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ বা নেই বললেই চলে। সুতরাং পরিবর্তন বা সংস্কার যাই করি না কেন, সেটি করতে হবে আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর পরিচালনা ব্যবস্থায়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ছাত্র-শিক্ষক সবাইকেই একটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট জবাবদিহিতা ও মূল্যায়ন কাঠামোর মধ্যে আনা খুবই জরুরি।
এ কাজ কঠিন, তবে অসাধ্য নয়। হ্যাঁ, সরকারের প্রতিটি স্তরই আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং এজন্য প্রয়োজন পৃথক পৃথক সংস্কার কাঠামো। তবে সংস্কার কাঠামো তৈরির জন্য সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা, মতামত গ্রহণ এবং পরীক্ষামূলক পাইলট প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে সফলতা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন। অতঃপর, বাস্তবায়ন। বিষয়গুলো সময় ও কষ্ট সাপেক্ষ এবং এজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞ উপদেষ্টাদের নিরলস প্রচেষ্টা। আশা করি তা তারা করতে পিছপা হবেন না।
সংস্কার নিয়ে আমরা যত কথাই বলি না কেন বা যত প্রচেষ্টাই করি না কেন, সব প্রচেষ্টা বা কষ্টই বিফলে যাবে, যদি রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোর সংস্কার করা না হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতার যে প্রাসাদে বসে আছে, তার মালিক হচ্ছে জনগণ। জনগণই একদিন এ প্রাসাদের দায়িত্ব দিয়েছিল শেখ হাসিনাকে।