রাষ্ট্রীয় বিধান পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবিতা
সেই ছোটবেলা থেকে প্রবাদবাক্যটা শুনে আসছি, ‘চোর না শোনে ধর্মের কাহিনি’-তা সে সিঁদেল চোর হোক বা জাহাজ চোর। আবার ‘ছাগল ধরিয়া যদি বল কানে-কানে, চরিতে না-যেও বাবা ফলের বাগানে’ কথাটাও শুনেছি। ছাগল কি ফলের চারা, গাছের কচি পাতা খাওয়া বন্ধ করে দেবে? কী করণীয়? আজীবন কি ধর্মের কাহিনি শুনিয়ে যাবেন, নাকি ছাগলের স্বভাবকে পরিবর্তন করবেন?
কোনোটাতেই কাজ হবে না; প্রয়োজনে বেড়া দিতে হবে। আইন তৈরি করতে হবে এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করে চৌর্যবৃত্তি বন্ধ করতে হবে। চোর ও ছাগল কি আইন তৈরি করে তাদের হাত ও মুখ বেঁধে রাখতে চাইবে? কখনো না, ‘যার যে স্বভাব, যায় না সে ভাব’। কাকে দিয়ে বিধানটা পরিবর্তন করবেন? অন্তর্বর্তী সরকার গণভোটের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে এ কাজ করবে। বিধান পরিবর্তনের এখনো উপযুক্ত সময় আসেনি। আগে আইনশৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা, সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে ঢেলে সাজানো। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। অতঃপর গণভোটের আয়োজন, সংবিধান পরিবর্তন, বিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠান, ক্ষমতা হস্তান্তর। আমার এ লেখা যথাসময়ের আগে হচ্ছে এ কারণে যে, বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক আলোচনা-মতামত রয়ে গেছে। তাদের লেখা পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত হবে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর পত্রিকায় প্রকাশিত পক্ষে-বিপক্ষের সব লেখা সংরক্ষিত করে কমিটির সামনে বিবেচনার জন্য পেশ করতে পারে।
জানি, বিধান পরিবর্তন বিষয়ে বিস্তারিত লেখা এত স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। আমি দফাগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই। বিধানের মূলনীতিতে পরিবর্তন আবশ্যক। ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতার উদ্দেশ্য লেখা ছিল-সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এগুলোকে প্রতিস্থাপিত করে সঙ্গে আরও দুটো মূলনীতি যোগ করা যায়-ধর্ম-সম্প্রদায় অহিংসতা এবং গণতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি ধর্ম না-বোধক শব্দ, উঠিয়ে দেওয়াই ভালো। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সব নাগরিক, সব ধর্মই সমান। এরপর সরকার ও রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তনই মূল কাজ।
সরকার কাঠামোতে রাজনৈতিক দল এবং ক্ষমতাসীন সরকারি দল অসীম ক্ষমতার অধিকারী। এ সুযোগটাই রাজনৈতিক দল নিচ্ছে। রাজনৈতিক দলই এদেশে সব অন্যায়ের সূতিকাগার। সব রাজনৈতিক দলকে বিধান পরিবর্তন করে জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার মধ্যে আনতে হবে। ট্রায়াল অ্যান্ড এরোর অনেক বছর ধরে করলাম, ওদিকে না যাওয়াই ভালো। কারণ যে দলই ক্ষমতায় আসুক, পুরোনো অভ্যাস ত্যাগ করতে পারবে না জানি। প্রতিটি দলে ভালো স্বভাবের লোকের তুলনায় খারাপ প্রকৃতির নেতাকর্মীর সংখ্যা অত্যধিক।
মানুষের মন তো কোনো যন্ত্রের ইঞ্জিন নয় যে ইচ্ছা করলেই বদল করে ফেলা যাবে; যে মানুষটা মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য একবার হারিয়েছে, তা কোনোদিনই আর ফিরে পাবে না। বিষয়টি সাইকোলজিক্যাল। এদেশের প্রত্যেক ব্যক্তির রাজনীতি করার অধিকার থাকবে বটে, কিন্তু সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারীদের সংশ্লিষ্ট দলের সদস্যপদ নিতে হবে। যে কোনো কর্মী বা নেতার অন্যায় কার্যকলাপের জন্য সংশ্লিষ্ট দলকে জবাবদিহি করতে হবে। শুধু নামমাত্র বহিষ্কার করা এবং মনে মনে আবার দলীয় কার্যক্রম ও যত অপকর্ম তাকে দিয়ে সমাধা করা বন্ধ করতে হবে। নইলে ওই দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার তো আমরা মনোযোগ দিয়ে বহু বছর ধরে দেখলাম। এটাও একনায়কতন্ত্রের নামান্তর। দেশের যত অপকর্মের হোতা, চোরাকারবারি, দুর্নীতিবাজ, টাকার বিনিময়ে সংসদের দলীয় সদস্যপদ কেনা, তার নির্বাচিত এলাকার মধ্যমণি হয়ে সব সরকারি উন্নয়ন বরাদ্দের ভাগবাঁটোয়ারা করা, এলাকার বিভিন্ন পক্ষ ও সমিতি, যেমন: দোকান মালিক সমিতি, ইটভাটা মালিক সমিতি, মুরগি খামার সমিতি, নেশা প্রতিরোধ সমিতি ইত্যাদি থেকে অবৈধ টাকা রোজগার করার ফাঁদ তারা তৈরি করেন।
আমরা জানি, প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন বিভাগ আছে। কাজ পরিচালনা ও সম্পাদনের জন্য প্রতিটি বিভাগে কর্মকর্তা আছেন। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। বিভিন্ন নির্বাচনি এলাকায় অর্থের বণ্টন ও উন্নয়ন কাজে অর্থের লেনদেন এবং অর্থ ও অনুদান সংশ্লিষ্ট ভাগবাঁটোয়ারার কোনো বিষয় ও ক্ষমতা থেকে সংশ্লিষ্ট এমপিকে দূরে রাখার বিধান থাকবে। এতে সরকারি টাকায় নিজের দলের লোকজন প্রতিপালন ও নিজের পকেট ভারী করার চলমান বাস্তবতার অবসান হবে। ফলে এমপি হওয়াটা কোনো লাভজনক পেশা হবে না। অর্থসংকট অথচ সুশিক্ষিত ব্যক্তি রাজনীতিতে আসবেন। দশ কোটি টাকা ব্যয়ে দলীয় নোমিনেশন কেনা, আরও বিশ কোটি খরচ করে নির্বাচনে জেতার চেষ্টা করা এবং পাশ করে হাজার কোটি টাকা কামানো ইত্যাদি ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সরকার পতন
- রাষ্ট্র সংস্কার