বিএনপি নিজেকে কতটা বদলিয়েছে
৭ আগস্ট নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশে খালেদা জিয়া ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তরুণদের দেখা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে মেধা, যোগ্যতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়, ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।’
আওয়ামী লীগ আমলে তাঁর মতো এতটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার কেউ হননি। দেশের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিতর্কিত মামলায় এক নাগারে সাড়ে ছয় বছর জেল খেটেছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চেয়ে বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। তাঁর শাস্তি স্থগিতের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে ছয় মাস পর পর আবেদন করতে হয়েছে। এতকিছুর পরও খালেদা জিয়া মুক্ত হয়ে ভালোবাসা ও শান্তির কথা বলেছেন। প্রতিহিংসা পরিহার করার কথা বলেছেন।
এর মধ্য দিয়ে তিনি আন্দোলনকারী তরুণদের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। তরুণেরা যে রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছেন, তাঁর পক্ষে মত দিয়েছেন। কারাগারে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়াও ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, একই ব্যক্তির দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকার কথা ছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও বলেছেন, আমরা ব্যক্তির বদলে ব্যক্তি নয়, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই।
কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বের কারও কারও আচরণ দেখে মনে হয় না তারা কেউ সংস্কার চান। পুরোনো ধারার রাজনীতিকেই নিজের উন্নতির সোপান বলে মনে করে তাঁরা। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
গত বুধবার রাতে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে দেখা। মাসখানেক আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা অন্তর্বর্তী সরকারকে কত দিন সময় দেবেন? তিনি বললেন, যত দিন সংস্কারকাজ শেষ করতে লাগে, তত দিনই দেব। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, তৃণমূলের নেতা–কর্মীদের সামলাতে পারবেন তো? তিনি অনেকটা হতাশার সুরে বললেন, ‘সামলাব কী? কেন্দ্রের নেতারাই তো মারামারি করছেন। আগে মারামারি থামাক, এরপর নির্বাচনের কথা ভাবা যাবে।’
তখনো পর্যন্ত ফরিদপুরের নগরকান্দার ঘটনা আমার জানা ছিল না। পরে জানলাম, বুধবার সকালে ফরিদপুরের নগরকান্দায় বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম ওরফে বাবুলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে একজন মারা যান। নিহত ব্যক্তির নাম কবির ভূঁইয়া। আওয়ামী লীগ শাসনোত্তর আমলে বিএনপির কর্মীদের হাতে বিএনপির প্রথম শহীদ।
শামা ওবায়েদ নগরকান্দা উপজেলার লস্করদিয়া ইউনিয়নের লস্করদিয়া গ্রামের বাসিন্দা। শহীদুল ইসলাম নগরকান্দার তালমা ইউনিয়নের কোনাগ্রামের বাসিন্দা। নগরকান্দা ও সালথা উপজেলা নিয়ে ফরিদপুর-২ সংসদীয় আসন গঠিত। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে এ দুই নেতার দ্বন্দ্ব অনেক আগে থেকে।
এ ঘটনার পর শামা ওবায়েদ ও শহীদুল ইসলামের দলীয় পদ স্থগিত করেছে বিএনপি। এতে কী প্রমাণিত হয়, বিএনপির নেতা–নেত্রীদের অনেকে এখনো রাষ্ট্র ও রাজনীতির সংস্কারের পক্ষে নন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে তারা আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের হাতে মার খেয়েছেন। এখন নিজেরা মারামারি করছেন।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীনরা গায়ের জোরে সবকিছু করতে চান। কিন্তু ফরিদপুরের ঘটনায় মনে হলো, ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির অনেক নেতা–নেত্রীও সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
এই প্রেক্ষাপটে বিবিসি একটি চমৎকার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে। তাদের ভাষায়, ‘বাংলাদেশে কোনো একটি সরকার পরিবর্তনের পর ব্যক্তির বদল ঘটলেও দুর্নীতি, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি কিংবা দখলের যে পুরনো ব্যবস্থা, সেটার পরিবর্তন খুব একটা হয় না। এবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও কমবেশি একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, প্রভাব খাটানো, এমনকি দখলের মতো অভিযোগ উঠছে বিশেষত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।’
বিএনপির শীর্ষ নেতারা এর সত্যাসত্য যাচাই করে দেখতে পারেন। সহকর্মী এম জসীম উদ্দীনের প্রতিবেদনে বরিশালের দখলবাজির চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বরিশালের দলের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এত দিন তাঁদের দখলে থাকা বাজার, মাছঘাট, বালুমহালসহ অন্যান্য স্থাপনা একে একে দখলে নিচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।