বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নদীর প্রতি কতটা আগ্রহী, দেড় দশক আগে লিখেছিলেন ‘নদী’ নামে আমার সম্পাদিত পানি ও প্রবাহ বিষয়ক বর্ষপত্রে। ‘শৈশবের নদী’ শিরোনামে ছোট্ট সেই স্মৃতিচারণে তাঁর গ্রামের বাড়ির পাশের খাল হয়ে হালদা ও কর্ণফুলী দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের চাক্তাই খালে পৌঁছার বর্ণনা শেষে লিখেছিলেন– ‘আমরা অপেক্ষায় থাকতাম প্রতিবার, কখন দাদা শহরে যাবেন, সাম্পানে চড়ে। আর সুযোগ হবে আমাদেরও যাবার, নদী দেখার। নদী দেখার সেই আগ্রহ আমার এখনও কমেনি।’ (নদী/ প্রকাশক, রিভারাইন পিপল/ মুদ্রণ ও পরিবেশন, আদর্শ/ মার্চ ২০১১)।
এ বছর মার্চেও একাধিক মামলায় জেরবার অধ্যাপক ইউনূসের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। রেকর্ডিংয়ের আগে নানা বিষয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে কৌতুক করে বলেছিলাম, বাংলাদেশে পত্রিকার প্রকৃত সার্কুলেশন এবং নদনদীর সংখ্যা জানা কঠিন। সরকারেরই একেক সংস্থা একেক হিসাব দিয়ে থাকে। তিনি হতাশকণ্ঠে বলেছিলেন– ‘দেখুন, গোড়ার কাজই কত বাকি!’
সেই মার্চের পর গত চার মাসে মরা বুড়িগঙ্গা দিয়েও অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তখনকার প্রবল প্রতাপান্বিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে, খোদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। তিনি নিজেই অনেক ‘গোড়ার কাজে’ হাত দিচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর্মসূচিতে নদী সুরক্ষার গোড়ার কাজগুলো থাকবে না?
কেবল মুহাম্মদ ইউনূস নন; বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে এমন কয়েকজন উপদেষ্টা রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে নদী, পানিসম্পদ ও পরিবেশ বিষয়ে কাজ করে আসছেন। নদী সুরক্ষায় আন্দোলন, আলোচনা, গবেষণা, অ্যাডভোকেসি, লেখালেখির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করেছেন।
যেমন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের পিএইচডি গবেষণার বিষয়ই ছিল আন্তর্জাতিক নদীর পানি বণ্টন ইস্যু। বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বাংলাদেশের নদী সুরক্ষা আন্দোলনে আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ফরিদা আখতার কেবল কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন; নদী বিষয়েও তাঁর প্রজ্ঞা ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে জানি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদের সঙ্গেও নদীবিষয়ক একাধিক দক্ষিণ এশীয় উদ্যোগে আমরা কাজ করছি। পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন যদিও মূলত কূটনীতিক; প্রাসঙ্গিকভাবেই আন্তঃসীমান্ত নদী বিশেষত তিস্তা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র নিয়ে অনেক দিন ধরে কলাম লিখছেন ও টকশোতে অংশ নিচ্ছেন।
তার মানে, সরাসরি নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত আইন, পানিসম্পদ, পরিবেশ, মৎস্যসম্পদ, পররাষ্ট্রের মতো মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্বে রয়েছেন উপযুক্ত ব্যক্তিরাই। নদীর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় রয়েছে সরাসরি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে। এই ‘নদীময় সরকার’ যদি নদী সুরক্ষায় গোড়ার কাজগুলো সম্পন্ন করতে না পারে, তাহলে আর কোন সরকার পারবে?
যদিও মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্পের মতোই, বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদকে নদী সুরক্ষার অগ্রাধিকার তবুও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারের বিপুল কাজের ভিড়ে নদী সুরক্ষার বিষয়গুলো পিছিয়ে না যায়।
নদী বিষয়ে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে নতুন সরকারের জন্য নদী সুরক্ষায় পাঁচটি অগ্রাধিকার প্রস্তাব করছি। প্রসঙ্গত, আন্তঃসীমান্ত নদীর ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিতেই হবে। কারণ সেগুলোর প্রবাহই দেশের প্রায় সব নদীকে সচল রাখে। কিন্তু এখানে আমি কেবল অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকারগুলোর কথা বলছি।