ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর এখনই সময়
বিরল ও অভূতপূর্ব ঘটনা অর্থনীতির জগতে। তিনজন প্রধানই অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। তারা তিনজনই অর্থনীতির ছাত্র, প্রতিষ্ঠিত গবেষক। এটা আগে কখনো বাংলাদেশে ঘটেনি। সরকারপ্রধানের কথা বাদ দিলাম, ইতঃপূর্বে অর্থমন্ত্রীদেরও সম্ভবত একজন বাদে আর কেউ অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। গভর্নর পদে আমলাদেরই প্রাধান্য ছিল, যদিও একবার/দুবার ব্যাংকাররা গভর্নর হয়েছেন, সম্ভবত দুবার অর্থনীতিবিদ গভর্নর হয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে বলা যায়, অর্থনীতি আজ অর্থনীতিবিদদের হাতে। যারা এতদিন বাইরে থেকে কথা বলতেন, পরামর্শ দিতেন, উপদেশ দিতেন, সমালোচনা করতেন-তারাই আজ দেশের অর্থনীতির মূল কর্তা। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তাদের আর পরামর্শ দিতে হবে না কাউকে। তারা অর্থনীতি, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্যার কথা জানেন। সমাধানের পথও তাদের জানা। দ্বিতীয়ত, তিনজনই মিডিয়ার পরিচিত মুখ। তাদের আরও সুবিধা এই যে, তারা আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা, প্রতিষ্ঠান, বিদেশি সরকারগুলোর কাছেও পরিচিতজন। সবচেয়ে বড় কথা, এ মুহূর্তে তাদের শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা। অতএব, দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে প্রচলিত রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন তাদের হতে হবে না। এ এক বিশাল সুযোগ, সম্ভাবনা-ভালো কাজ করার। এতগুলো সুবিধায় বলিষ্ঠ অর্থনৈতিক নেতৃত্বের কাছে জাতির আশা অনেক বেশি। বাকিটা ভবিষ্যৎ বলবে। সেটা পরের কথা।
এ মুহূর্তের কাজ হিসাবে নতুন নিযুক্ত অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি কৃষকের সার, জ্বালানি তেল, শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারি আমদানিতে গুরুত্ব দেবেন। যুগান্তরে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, তিনি অর্থনৈতিক খাত সচল করতে এবং অস্থিরতা কমিয়ে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চান। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসবেন। বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একার পক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়-যদিও এটাই তাদের প্রধান দায়িত্ব। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছেন; তিনি সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক ভালো করার তুলনায় মানুষের জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য ফেরাতে চান। মোটা দাগে এই হচ্ছে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যেদিন লিখছি, সেদিন পর্যন্ত গভর্নর গতিশীল হননি, আর প্রধান উপদেষ্টার মতামত সম্পর্কে দেশবাসী, বিশ্ববাসী সবাই অবগত। অতএব, ওই দিকে যাচ্ছি না।
নজর দেওয়া যাক অতি জরুরি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে। অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি, প্রবাসী আয়, কৃষি-সবই নির্ভর করে ব্যাংকগুলোর ওপর। ব্যাংকগুলো ঠিক না হলে কিছুই সম্ভব নয়। অন্য আরও বিষয় অবশ্যই আছে। তবে ব্যাংকিং শৃঙ্খলাটি প্রথম। এ খাতটি নানা সমালোচনায় জর্জরিত। এর ভাবমূর্তি তলানিতে। এর কারণ অনেক, যার মূলোৎপাটন করতে হবে। এর জন্য আমি মনে করি তিন ধরনের পদক্ষেপ দরকার : দ্রুত, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি। এসবে কোনো আবেগের স্থান নেই। বাস্তবোচিত পদক্ষেপ দরকার। অতএব, গোড়া থেকে শুরু করি। প্রথমেই দরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকটিকে মেরামত করা। এটিকে একটি ‘রাবার স্ট্যাম্প প্রতিষ্ঠানে’ পরিণত করেছেন সবজান্তা আমলারা। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন, ব্যাংকগুলোকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়েছেন। ব্যাংকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বেঁধেছে অদক্ষতা, অকর্মণ্যতা, অপদার্থতা আর অনিয়ম। অভিযোগ আছে ঘুস-দুর্নীতিরও, যা এক সময় ছিল কল্পনাতীত। বাংলাদেশ ব্যাংক একটা ‘পলিসি নৈরাজ্য’ সৃষ্টি করেছে। তারা মানুষকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুল বুঝিয়েছে। সর্বোপরি প্রতিষ্ঠানটি পরিণত হয়েছিল লুট, প্লান্ডার, অনিয়ম ও বিগ বিজনেসের বিচরণক্ষেত্রে। গভর্নররা পর্যন্ত মাফিয়াদের দ্বারা আক্রান্ত হতেন তাদের চেম্বারে। ব্যাংকের ক্ষমতায়ন, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শত শত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, স্বার্থ ঘুচিয়েছেন। কর্মচারীদের দ্বারা কর্মকর্তাদের পেটানোরও নজির আছে। নৈরাজ্যের চূড়ান্ত। এসব থেকে মুক্ত করার জন্য এক নম্বর পদক্ষেপ হোক ‘ব্যাংকিং ডিভিশন’ বিলুপ্তি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগ বিনা কারণে সৃষ্টি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা, কার্যপরিধি নষ্ট করা হয়েছে। পদে পদে তারা হস্তক্ষেপ করে। অথচ ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, আইনি দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এ বিভাগের কোনো দায়িত্ব নেই। আছে খবরদারি আর সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার মাতব্বরি। প্রতিটি ব্যাংকের ডজন ডজন গাড়ি থাকে এই বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শেষ করেছে, ব্যাংকগুলোকেও শেষ করেছে। অবিলম্বে তা তুলে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হোক। সরকারকে ঢালাওভাবে ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা রহিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন হোক।
দ্বিতীয় যে কাজটির কথা কেউ বলবে না, তার কথা বলতে হয়। আজ দেখা যাচ্ছে ব্যাংকে ব্যাংকে কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ। এর অনেক কারণ। দীর্ঘমেয়াদি শাসনে একশ্রেণির ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তা মালিক/সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে ব্যাংকে ব্যাংকে স্বৈরশাসন কায়েম করেছেন। তারা ব্যাংকের স্বার্থ দেখেননি। মালিকের স্বার্থ দেখে পদোন্নতি নিয়েছেন। মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিয়েছেন। এসব দিতে নিচের কর্মকর্তাদের বাধ্য করেছেন। হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছেন। পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। ব্যাংকে ব্যাংকে খেলাপি ঋণগ্রহীতা তৈরির জন্য এরাই দায়ী। সাধারণ ঋণগ্রহীতাদের কোনো মূল্য নেই। তারা বড় বড় গ্রাহকের স্বার্থ দেখেছেন। ওইসব বড় বড় কর্মকর্তার একটা অংশ মালিকদের অর্থ পাচারেও সাহায্য করেছেন। ভুল তথ্য দিয়েছেন সর্বত্র। দানবিক একটা সাম্রাজ্য ব্যাংকে ব্যাংকে। ব্যাংক খাতের ওইসব দানবের নাম সবারই জানা। তাদের অপকর্মের কথা সবারই জানা। ১৪ তারিখে যুগান্তরে তা ছাপা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রথমেই দরকার ব্যাংকারদের-সৎ, কর্মঠ, দক্ষ ব্যাংকারদের-মনোবল ফিরিয়ে আনা। চারদিকের প্রাপ্য, অপ্রাপ্য সমালোচনায় তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। ব্যাংকের ‘তালুকদাররা’ ব্যাংকে ব্যাংকে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। বছরের পর বছর পদোন্নতি নেই। এর বিপরীতে খাতিরের লোকের চাকরি, ‘এলাকার’ লোকের চাকরি, পদোন্নতি, দফায় দফায় পদোন্নতি হয়েছে। প্রশাসনে যা ঘটেছে, ব্যাংকে ব্যাংকেও তা-ই ঘটেছে। প্রশাসনের অবিচার দেখছি সমাধান হচ্ছে। অবিলম্বে ব্যাংকে বছরের পর বছর পদোন্নতিবঞ্চিতদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। বরখাস্ত, চাকরিতে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি ফেরত দেওয়া হোক। বিচারের আওতায় আনা হোক দুর্নীতির গডফাদার ব্যাংক মালিকদের দোসর ব্যাংকারদের। এটা জরুরি কাজ। সবাইকে আশ্বস্ত করুন। সবাইকে উৎসাহ দিন। তাদের কাছ থেকে ব্যাংকের সমস্যা জানার চেষ্টা করুন। কীভাবে ‘দুই নম্বরি’ হয়েছে, কারা কীভাবে তা করেছে, তাদের সাহস দিলে তারা বলবে। এতে কাজ করতে সুবিধা হবে।