ছাত্র-জনতা যেসব ‘সংস্কার’ চেয়েছিল
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ আবার বিশ্ব-সংবাদ হলো; তবে এবার অনেক বড় বিশ্ব তাৎপর্য নিয়ে। পৃথিবীজুড়ে যখন গণতন্ত্রের দুর্দিন, নানা দেশে স্বৈরাচারদের দাপট চলছে, তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারের পক্ষে হলো অনন্য এক জন-অভ্যুত্থান। বিস্মিত বিশ্ব ছাড়াও পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় এই ঘটনার প্রবল ছাপ পড়েছে। কয়েক শ মানুষ সরাসরি জীবন দিয়ে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের পক্ষে রায় দিয়েছে, যা উত্তর-ঔপনিবেশিক বৈশ্বিক রাজনীতির ইতিহাসে ইতিমধ্যে এক বড় ঘটনার স্বীকৃতি পাচ্ছে ভাষ্যকারদের কাছে। কিন্তু তা থেকে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে রাজনৈতিক শান্তি আসবে কি?
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে ২০২৪
আপাতত সংস্কারের এজেন্ডা হিসেবে শিক্ষার্থীরা কোটা প্রশ্ন নিয়ে সামনে এলেও বিষয়টা হঠাৎ আসেনি। হঠাৎ এভাবে হাজার হাজার আবু সাঈদরা বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেয়নি। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনেও ‘রাষ্ট্র মেরামতে’র প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে এনেছিল কিশোর-তরুণেরা। কেউ মোটাদাগে গুরুত্ব দেয়নি।
এটা বেশ কাকতালীয় ঘটনা যে সেই আন্দোলনও হয় এবারের মতো জুলাই-আগস্টে। ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনী রক্তগঙ্গায় সে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে। কিন্তু সেই রক্ত থেকে লাখে লাখে নতুন প্রাণ জেগেছে বলেই মনে হলো এবার। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের আগে-পরে শুরু হওয়া ২০১৮ সালের কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে মূলত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার প্রশ্ন বড় হয়ে উঠতে থাকে দেশজুড়ে। তবে এসবের আরও পেছন ফিরে দেখলে আমাদের মনে পড়বে সংস্কারের এই রাজনীতির শুরু ১৯৭০-৭১–এর আগে থেকেই—‘৬ দফা’ ও ‘১১ দফা’র সময় থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভেতর ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জায়গায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা, স্বাধীনতার বিষয়টাই প্রধান হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ায় ১৯৯০ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে ‘১০ দফা’ নিয়ে গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়, সেখানেও প্রধান দাবিগুলো ছিল রাষ্ট্র মেরামত–সংক্রান্ত। তখন ১৫ দল, ৭ দল ও ৫ দল মিলে যে তিন জোটের ‘রূপরেখা’ দিয়েছিল, সেটাও ছিল একধরনের রাজনৈতিক সংস্কার উদ্যোগ।
তবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১০ দফা ছিল প্রকৃতই এক বিস্তারিত সংস্কার দাবি। সেখানে সমাজ, অর্থনীতি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনসহ অনেক বিষয়ে রাষ্ট্রের সামনে সুস্পষ্ট করণীয় ও নির্দেশনা ছিল। রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতায় এসে সেসব সংস্কার করেননি।
জনতা হাল ছাড়েনি
নব্বই–পরবর্তী গত তিন দশকে বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কারের ধারণায় অনেক নতুন বিবেচনা যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে এ সময় ছাত্র-জনতা সুশাসনের সংকটের গোড়ার জায়গাটা শনাক্ত করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তার ডাক উঠেছে বহুদিক থেকে।
একটি দলের বদলে আরেকটি দলের ক্ষমতা দখলে, এমনকি সেটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে হলেও যে বাংলাদেশের শাসনতান্ত্রিক সংকট মিটছে না, সেটা ইতিমধ্যে গত তিন-চার দশকে স্পষ্ট।
ব্রিটিশদের তৈরি এই রাষ্ট্র ও প্রশাসন সমাজের কোনো দিকে শান্তি, স্বস্তি, স্থিতিশীলতা, ন্যায়বিচার আনতে পারছে না। একদল ‘অবিশ্বাস্য ধনী’ তথা ‘ভি-ভিআইপি’ তৈরি ছাড়া চলতি শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর কোনো বড় অর্জন নেই। বহু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দল ক্ষমতায় এসেছে গত পাঁচ দশকে। যারাই চলতি শাসনতন্ত্র হাতে পেয়েছে, তারাই স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছে।