মৎস্যচাষে নতুন প্রযুক্তি

যুগান্তর এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার প্রকাশিত: ০৫ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৫১

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২’ বৈশ্বিক প্রতিবেদন মতে স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীতে তৃতীয়। শুধু তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। সারা বিশ্বে মোট মাছের চাহিদা ১৭৮.৮ মিলিয়ন টন এবং এর এক-তৃতীয়াংশ জোগান দেয় চীন। সে হিসাবে বিশ্বের বৃহত্তম মাছ উৎপাদনকারী দেশ হলো চীন। চাহিদার ৮ শতাংশ মাছ উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। অন্য শীর্ষ দেশগুলো হলো ইন্দোনেশিয়া, পেরু, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এ তালিকায় মিসর, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের নামও আছে। বাংলাদেশ প্রতিবছর সমুদ্র থেকে ৬ লাখ ৭০ হাজার টন মাছ সংগ্রহ করা ছাড়াও পুকুর ও হাওড়-বাঁওড়ে মৎস্য উৎপাদন প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মাছের সাইজ, ওজন, রং ও স্বাদ সবকিছুই বেড়েছে। দেশে মৎস্যচাষে এ সফলতার পেছনে আছে মৎস্য বিভাগের বহুমুখী গবেষণা, আধুনিক পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির সহায়তা। এসব প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম হলো রাস, আইপিআরএস এবং বায়োফ্লক পদ্ধতি।


রাস পদ্ধতি : মাছ চাষে যান্ত্রিকীকরণের জন্য আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় প্রযুক্তিতে বিদ্যমান সম্পদ ব্যবহার করে কম খরচে আধুনিক পদ্ধতির নাম রিসারকুলেটিং একোয়াকালচার সিস্টেম (রাস)। এ পদ্ধতিতে বিদ্যমান মাছ চাষের চেয়ে ৮০-১০০ গুণ বেশি মাছ উৎপাদন সম্ভব। তাছাড়া দেশীয় সম্পদ ও কারিগরি দক্ষতা ব্যবহার করে অত্যন্ত কম মূল্যে এ প্রযুক্তি ব্যবহারযোগ্য। যে কোনো বদ্ধ জলাশয়ে এক শতকে ২-৩ কেজি এবং নিবিড় চাষ করা গেলে সর্বোচ্চ ২০-৩০ কেজির মতো মাছ চাষ করা যায়। এভাবে প্রতি ঘনমিটার জায়গায় ১ হাজার লিটার পানিতে ‘রাস’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ৮০-৯০ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব। এ পদ্ধতিতে ব্যবহৃত প্রতিটি ট্যাংক সাড়ে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার লিটার পানি ধারণ করতে পারে। সে হিসাবে একটি ১০ হাজার লিটার সম্পন্ন প্রতি ট্যাংকে উৎপাদন করা যায় ৮০০ কেজি মাছ। ‘রাস’ পদ্ধতিতে মাছের মল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্যাংক থেকে ফিল্টারিং করে একেবারে তলানিতে নিয়ে আসা হয়। এজন্য এ পদ্ধতিকে রেসওয়ে বটমক্লিন পদ্ধতি বলা হয়। পরবর্তী সময়ে এ মল বের করে একুয়াফনিক্সসহ বিভিন্ন কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায়। ট্যাংকে নতুন পানি সরবরাহের জন্য ছোট একটি মোটরের প্রয়োজন হয়, যেটিকে সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যবহার করা যায়। আর বাতাসের অক্সিজেন পানিতে মিশিয়ে বুদ্বুদ তৈরির মাধ্যমে মাছের অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।


বায়োফ্লক পদ্ধতি : দেশীয় আবহাওয়ার উপযোগী করে পুকুর না কেটে স্বল্প খরচে অধিক মাছ চাষের নতুন এক প্রযুক্তির নাম ‘বায়োফ্লক’। পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি যা ক্রমাগতভাবে পানিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানগুলোকে পুনরাবর্তনের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করে। সাধারণত মাছের জন্য পুকুরে যে খাবার দেওয়া হয়, তার উচ্ছিষ্ট পুকুরে দূষিত অ্যামোনিয়া তৈরি করে, যা মাছের জন্য ক্ষতিকর। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া থেকেও প্রোটিন তৈরি করে মাছের খাদ্য হিসাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়। এতে মাছের খাবার খরচ কমে যায়। এ প্রযুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো মাছের মজুত ঘনত্ব দ্রুত বাড়ে। সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে ১০টি মাছ চাষ করা যায়, এ পদ্ধতিতে সেখানে ৩০টি পর্যন্ত মাছ চাষ করা যায়। এ প্রযুক্তি পানিতে বিদ্যমান কার্বন ও নাইট্রোজেনের সাম্যবস্থা নিশ্চিত করে পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে। এ পদ্ধতিতে বাড়ির আঙিনায়, ছাদে, অল্প জায়গায় এমনকি সবজি ও মাছ একসঙ্গে চাষ করা যায়। মাছ চাষের জন্য ট্যাংক, অক্সিজেন সরবারাহের পাম্প ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়। প্রথমে ট্যাংকে পানি দিয়ে এক সপ্তাহ অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এতে আয়রন বা অন্য ভারী পদার্থ থাকলে ওপরে জমা হয়। এরপর প্রতি ১ হাজার লিটারে ১ কেজি হারে আয়োডিনমুক্ত সাধারণ লবণ প্রয়োগ করতে হয়। অতঃপর টিডিএস ১২০০-এর ওপরে হলে প্রতি ১ হাজার লিটারে ১০ গ্রাম চুন প্রয়োগ করতে হয়। পিএইচ ৭.৫-এর কাছাকাছি হলে ভালো ব্যাকটেরিয়া নির্দিষ্ট অনুপাতে পানিতে দিতে হয়। সঙ্গে কার্বন সোর্স হিসাবে মোলাসেস ৫০-১০০ গ্রাম দিতে হয়। সব সময় অক্সিজেনের সরবরাহ রাখা জরুরি। দুসপ্তাহ পর এতে ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া, শৈবাল তৈরি হয়, যা মাছের জন্য খুবই উপকারী। এ পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় বেশি পরিমাণ মাছ চাষ করা যায়, তাই অধিক লাভজনক। বাড়িতে যে কেউ সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে ১০-১২টি ট্যাংকে সহজেই মাছ চাষ করতে পারে।


আইপিআরএস-ইন-পন্ড রেসওয়ে সিস্টেম (আইপিআরএস) : যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত মাছ চাষের সর্বাধুনিক একটি প্রযুক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাবামা রাজ্যে অবস্থিত অ’বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৫ সালে প্রথম উদ্ভাবন করা হয়। তবে ২০১৩-১৪ সালের দিকে চীনে এ প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত এবং পাকিস্তানেও এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছ চাষ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশেও এর ব্যবহার অনেক। এটি হলো মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর, খাঁচা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অক্সিজেন-খাদ্যের সুষম বণ্টনের একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা। এর মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতি, বিদ্যুৎ ও কৌশল ব্যবহার করে স্বল্প জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণে মাছ চাষ করা হয়। এ প্রযুক্তিতে বড় আকারের পুকুরে কংক্রিটের ছোট ছোট চ্যানেল তৈরি করা হয়। সেখানে কৃত্রিম স্রোত তৈরি করে অনেকটা নদী বা প্রাকৃতিক জলাশয়ের মতো পরিবেশ তৈরি হয়। এ ধরনের প্রকল্পে পুকুরের মাঝে রেসওয়ে বা কংক্রিটের ছোট ছোট সেল তৈরি করা হয় এবং সেলের মধ্যে থাকা মাছগুলো স্রোতে ক্রমাগত নদীর মতো সাঁতার কাটতে থাকে। এ কারণে আইপিআরএস পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছের স্বাদ ও রং একেবারে নদীর মাছের মতোই হয়। এভাবে স্বল্প জায়গায় অনেক বেশি পরিমাণ (প্রায় ১০ গুণ) মাছ উৎপাদন করা যায়।


আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরার আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এদিকে স্থলভাগের মোট কৃষিজ আয়ের শতকরা ২৪ ভাগের বেশি অবদান মৎস্য খাতে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এ হার আরও বেড়েই চলেছে, যুক্ত হচ্ছে শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীও। বিবিএসের সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ মৎস্য কাজে নিয়োজিত এবং তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বছরে গড়ে ৩৫ লাখ ৪৮ হাজার টন মাছ উৎপাদিত হচ্ছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণই প্রায় ২০ লাখ টন। ইলিশের উৎপাদন প্রায় চার লাখ টন। সরকার মাছ রপ্তানি করে বছরে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। চিংড়ি এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য। মুক্ত জলাশয়ে প্রাকৃতিক এবং ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাখ লাখ পুকুরে মাছ চাষে দেশে রুপালি বিপ্লব ঘটে চলেছে। আর বাঙালি ফিরে পেয়েছে সেই পুরোনো প্রবাদ ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। আশা করা যাচ্ছে খুব শিগ্গির বাংলাদেশ চীনকে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থানে পৌঁছে যাবে। সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে নিত্যনতুন প্রযুক্তির সঙ্গে দেশের মৎস্যচাষিদের সম্পৃক্ত করতে হবে, ব্যবস্থা করতে হবে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও হাতেকলমে দক্ষতা অর্জনের। খামারগুলোয় সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের নিয়মিত পরিদর্শন, পর্যবেক্ষণ ও তদানুযায়ী কারিগরি সহায়তার ব্যবস্থা করা, উৎপাদিত মাছ দ্রুত পরিবহণে এবং বাজারজাতকরণে সহায়তা করা, মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে খামারিদের তথ্যের আদান-প্রদানে সহায়তা করা, সহজ শর্তে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি (বেকারত্ব মোচন) এবং সর্বোপরি দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে মৎস্য রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম হতে পারে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও