তন্ত্র নাশের মন্ত্র কী?
গত দু’সপ্তাহের বাংলাদেশকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে। মনেই হচ্ছে না যে, দেশে কোনো শাসনব্যবস্থা আছে। চারদিকে হতাশা আর নিরাশার অন্ধকার; ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারছে না কেউ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মতো একটি যৌক্তিক দাবির বিপরীতে জানমালের এত বড় ক্ষয়ক্ষতি কল্পনার বাইরে ছিল। আন্তর্জাতিক সমাজ বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি তার একটি নিবন্ধে বলেছেন, যে সরকার সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাকে ব্যর্থ সরকার বলতে হবে। আমাদের এ পরিস্থিতিতে যে সরকার ক্ষমতায় আছে, সেটি কোন ধরনের সরকার, তা বিচারের ভার রইল সচেতন নাগরিকদের ওপর। তবে এ ঘটন-অঘটনগুলোর সম্পূর্ণ দায় বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর ওপরই বর্তায়।
কোটা সংস্কারের মতো একটি মামুলি বিষয়ের নিষ্পত্তি না করে ক্ষমতার দাম্ভিকতার কারণে অপূরণীয় ক্ষতির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে দেশকে। মধ্য জুলাই থেকে যেসব হত্যার ঘটনা দেশব্যাপী সংঘটিত হয়েছে, তা বহুমাত্রিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোনো সময়কে হার মানিয়েছে। সরকারি হিসাব মতেই নিহতের সংখ্যা ১৫০। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছে, এ সংখ্যা ২৫০-এর কম নয়। আমরা যদি সরকারি হিসাবকেও আমলে নিই, তাহলেও বলতে হবে এ প্রাণহানি স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোনো আন্দোলনে প্রাণহানিকে তুচ্ছ করেছে। চলমান হত্যাকাণ্ডের আরেকটি দিক হলো মৃতের ধরন। এখানে বেশির ভাগই কোমলমতি শিক্ষার্থী; সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন পেশার মানুষ, এমনকি বাড়ির মতো নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা চার বছরের শিশুও ঘাতকের শিকার হয়েছে। এ শত শত প্রাণ ও কোটি কোটি টকার সম্পদের দায় বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে। এত বড় জানমালের দায় বিগত পাঁচ দশকের কোনো সরকারের ঘাড়ে চাপেনি।
অনেকেই মনে করেন, সামান্য কোটা সংস্কারের সমস্যাটা ১০ মিনিটেই সমাধানযোগ্য ছিল, এত প্রাণহানির প্রয়োজন ছিল না। এটি খুব সাধারণ অর্থে সত্যি। ক্ষমতার দাপটে থাকা কোনো শাসকের বেলায় তা সত্যি নয়। যিনি শাসন ক্ষমতায় আছেন, তিনি কোনো ধরনের যৌক্তিক দাবি শুনতে নারাজ। অবশ্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে কিছুটা সরে আসতে বাধ্য হয়েছে সরকার। কিন্তু ততক্ষণে রাষ্ট্র ও সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কি শুধুই সরকারি চাকরির কোটা নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে? এদেশে কর্মজীবীর সংখ্যা সাত কোটি ৫০ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে সরকারি কর্মজীবীর সংখ্যা ১২ লাখের মতো। শূন্য পদ আছে তিন লাখ, মোট ১৫ লাখ। সুতরাং এ ক্ষুদ্র আকারের সুযোগের কারণে এমনতর বিক্ষুব্ধ নয় তারা। বহুমাত্রিক বঞ্চনা শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ করেছে। আবাসিক হলগুলোতে সরকারি দলের নিপীড়ন, সিট বাণিজ্য, জবরদস্তি, বেকারত্ব, রাজনৈতিক আধিপত্যসহ সব বঞ্চনার সমাহার ঘটেছে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ। গত ১০ বছর ধরে সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বচাপে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না; এর প্রতিবাদও করতে পারছিল না। আজ তারা সেই সুযোগটি নিয়েছে। মানুষকে দাবিয়ে, মানুষের কথা উপেক্ষা করে, জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে বেশি দিন শাসন ক্ষমতায় থাকা যায় না। সরকার যদি এ সত্যটি আজও উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে তা দুঃখজনক এবং এর পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হবে।
সরকারের বাড়াবাড়ির কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নিয়েছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে। এত প্রাণের বিসর্জন না হলে হয় তো এতদূর এগোত না। আজকের প্রজন্ম মনে করে এই যে এত রক্তপাত, এর সুষ্ঠু বিচার এ সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কেননা, তারা নিজেরাই এ রক্তক্ষয়ের জন্য দায়ী। তাই তারা শাসকশ্রেণি ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চায়; সেই দাবিতেই রাজপথে অবস্থান নিয়েছে। এর সমর্থনে সম্পৃক্ত হয়েছে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ। চিন্তার স্বাধীনতার প্রশ্নে, মানুষের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে, গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নে, দম আটকানো রাজনৈতিক পরিবেশের প্রশ্নে সাধারণ মানুষ এখন একটি সন্তোষজনক উত্তর চায়।