প্রয়োজন আত্মসমালোচনা
কুমির আর শেয়ালের গল্প। শেয়াল আর কুমির গেল আলু চাষ করতে। মাটির উপর যা গজাবে, কুমির পাবে; মাটির নিচেরটা শেয়ালের। ঠকে গিয়ে কুমির ভাবল, এবার ধান চাষের সময় আমি নেব নিচের ভাগ। এবারও কুমির ঠকল। গল্পটা স্কুল বইয়ে আছে। একবার একদল শিশু শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ শেয়ালটা তো দুষ্টু; বন্ধুকে ঠকাল। ভালো শেয়াল হলে কী করত-বলো তো? একজন সঙ্গে সঙ্গে বলল-সমান সমান ভাগ করত। গ্রাম্য শিশু, গেম থিওরি জানে না, জানে না গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে প্যাঁচ কষাকষি, শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিভাজনের কূটচাল। তাই তার উত্তর সোজা পথে-কিন্তু একেবারেই সঠিক পথে। ভাগাভাগির সমস্যা ততটা বুঝতে না পারলেও সবাইকে সমানভাবে সঙ্গে নিয়ে এগোনোর আদর্শের মাহাত্ম্য ফুটে উঠল ওই শিশুর বিচারে।
এদেশে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু সমস্যা, বিভাজনের সমস্যা, আমরা-ওরার সমস্যা মূলত রাজনৈতিক। নেকড়ে বাঘ আর মেষ শাবকের গল্পের মতো। নেকড়ে বাঘ মেষ শাবককে বলল-‘তুই না হলে নিশ্চয়ই তোর বাপ পানি ঘোলা করেছিল।’ এই বাঘটা রাজনীতির চোরাবালিতে কখন যে আমাদের মধ্যে ঢুকে বসে আছে, তা আমরা টেরও পাইনি; আর তাই তাকে কখনো তাড়াতেও পারিনি। এখন সুযোগ পেলেই সে বাঘটা প্রায়ই বেরিয়ে আসে। আঁচড়ে-কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে স্রেফ রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির লোভে। যে কোনো বিতর্কিত ঘটনার ক্ষেত্রে এক পক্ষকে সমর্থন করে বিপক্ষকে দুটি কথা শোনানো রাজনীতিতে প্রায় একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই পড়ে। কিন্তু সেই সূত্র ধরে যখন রাজনৈতিক শালীনতার সীমা পেরিয়ে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে অপমান, উপহাস, অত্যাচার, নির্যাতন করে কিংবা ঘৃণা ছড়িয়ে কেউ উল্লাস প্রকাশ করতে চায়, তখন তাকে রাজনৈতিক ব্যাধি ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই।
পৃথিবীর অনেক দেশেই ক্ষমতাসীন সরকারের আস্ফালনের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের অর্থাৎ যুবশক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। ঘুমিয়ে পড়া বাংলাদেশের যুবসমাজ নিয়ে কটাক্ষ করতে করতে এবার সর্বস্তরের হার-না-মানা ছাত্রছাত্রীদের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণিত হলো-বাংলাদেশে আজও ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন ঠেকানো অসম্ভব। শতাব্দীপ্রাচীন মেধা উৎকর্ষের পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জন্ম নিয়েছে একের পর এক কালজয়ী ছাত্র আন্দোলন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের আন্দোলন-এসব ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের পাশেই স্থান করে নিল এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
১৬০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। চীনে তখন সরকারি চাকরিতে শুধু আমলাদের কোটা ছিল। বিশ্বে শুরু হয়েছিল সেই প্রথম ছাত্র আন্দোলন। সরকারি চাকরির দাবিতে চীনের ইম্পেরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে শুধু আমলাদের পরিবারের কোটা বিলোপের জন্য তিরিশ হাজার শিক্ষার্থী সম্রাটের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কাকতালীয় হলেও সেই চীন সফর শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরেই ছাত্র আন্দোলনের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন।
ছাত্রছাত্রীদের দীর্ঘদিনের নানা ক্ষোভ, সমাজজীবনে দুর্নীতির ছড়াছড়ি, ভোটবিহীন সংস্কৃতির বাস্তবতা, ভবিষ্যৎ জীবনের সুনিশ্চিত চাকরির নিশ্চয়তা ইত্যাদি নানাবিধ হতাশার জায়গাগুলো ছাত্রছাত্রীদের সংবেদনশীল মনকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল। তারুণ্যের জেদ কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেনি। তারা কোটা সংস্কারের স্পর্শকাতর ইস্যুকে হাতিয়ার করে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে বুক পেতে দেয় বন্দুকের সামনে। ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যুতে আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। কোটি মানুষের হৃদয়ের শূন্যস্থানে চিরকাল সেই ছাত্রটির জন্য অপেক্ষার হাহাকার থাকবে। আমরা জানি, সেই শূন্যস্থান কোনো দিন পূরণ হবে না। সাঈদের জন্য শুধু অপেক্ষাই থাকবে। কিন্তু সেই অপেক্ষার শূন্যের মধ্যেও একটি জায়গা, একটি স্পেস থাকবে চিরকাল। সাঈদের মৃত্যুতে তৈরি হয়েছে এক অসীম গহ্বর, যেখানে তাকালেই দেখতে পাই রক্তাক্ত অন্ধকার; বিশাল এক শূন্যতা। সেই অন্ধকারে বুকটা হাহাকার করে ওঠে কোটি ছাত্রের, কোটি মানুষের। সেই অন্ধকারে সাঈদের পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আরও কত নাম না-জানা শিশু। এক বিরাট শূন্যের মাঝে শুধু লাশ আর লাশ। মানুষের লাশ, সন্তানের লাশ, শিক্ষার্থীর লাশ। তারই পাশে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপুল পরিমাণ সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক ভবন, অত্যাধুনিক ও সুসজ্জিত মেট্রো স্টেশন, সরকারি টেলিভিশন ভবন, সরকারি গাড়ি। এসব ক্ষতি অবশ্যই চোখে পড়ার মতো। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্য আয়ের উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর হওয়া বাংলাদেশ তার সম্পদ ধ্বংসের ক্ষতি অনায়াসেই পূরণ করতে পারবে। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের জীবন, শিশুদের প্রাণ বিসর্জন-এই ক্ষতি কি পূরণ করতে পারবে বাংলাদেশ?