গণমাধ্যম কেন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু?
সাম্প্রতিক সহিংসতা ও তার পরবর্তী পরিস্থিতির ভেতর গত ৩১ জুলাই বরিশালের দুটি ছবি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত এক পুলিশ সদস্যকে দুজন তরুণ কোলে করে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে সংঘর্ষের ছবি তোলায় একজন সিনিয়র ফটো সাংবাদিককে লাঠি দিয়ে বেদম মারছে পুলিশ।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে লাঠিচার্জের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের হামলার শিকার হয়েছেন বরিশালের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। আহতদের মধ্যে তিনজন হাসপাতালে ভর্তি। আরও ৪-৫ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। দৈনিক যুগান্তরের ফটো সাংবাদিক শামীম আহম্মেদ বলেন, “লাঠিচার্জের সময় আমি মাটিতে পড়ে যাই। আমার হাতে ক্যামেরা। পুলিশ তখনো আমাকে লাঠিপেটা করে। আজকের ঘটনায় পুলিশ মোটেও পেশাদার আচরণ করেনি।”
আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা বলেন, লাঠিচার্জকারী টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন উপ-কমিশনার। সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জকারী পুলিশ সদস্যদের কাছেই ছিলেন তিনি। এই পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের লাঠিচার্জ করতে নিবৃত্ত করেননি। এ সময় পুলিশ সদস্যরা সাংবাদিকদের গালিগালাজ করেছেন বলেও জানান তারা।
যে কোনো আন্দোলন বা সংকটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি অবস্থান করে সংবাদ সংগ্রহ করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশের লাঠিচার্জ কিংবা টিয়ার শেল নিক্ষেপের মতো ঘটনার ছবিও গণমাধ্যমের আলোকচিত্র সাংবাদিক ও ক্যামেরাপারসনরা ধারণ করেন। কিন্তু ওই ছবি তুলতে গিয়ে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিপেটার শিকার হবেন— এটি লজ্জার। পুলিশ যদি আন্দোলনকারী এবং গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে একই আচরণ করে, তাহলে দেশে আর সাংবাদিকতা করা সম্ভব নয়। বরং বিক্ষোভকারীদের কেউ যদি চড়াও হয়, তাদের হাত থেকে সাংবাদিকরদের রক্ষা করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। অথচ ঘটছে উল্টো। তার মানে কি এই যে, পুলিশ কিংবা রাষ্ট্র চায় না সাংবাদিকরা ঘটনার চিত্র ধারণ করুক কিংবা ঘটনাস্থলে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করুক?
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন এবং তার জের ধরে সহিংসতা চলাকালে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এসব আক্রমণের ধরন দেখে মনে হয়েছে তারা পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার। বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়িও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয় যেদিন, অর্থাৎ গত ১৯ জুলাই— সেদিন রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে সংবাদ সংগ্রহ করে ফেরার পথে হাতিরঝিল এলাকায় কতিপয় বিক্ষোভকারীর তোপের মুখ থেকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার। তার কাছ থেকে ঘটনার যে ভয়াবহতা শুনেছি, সেটি গা শিউরে ওঠার মতো।
কেন গণমাধ্যমকর্মীরা এরকম আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হলেন তার অনেক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। গণমাধ্যমগুলো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে কিনা বা সংকটকালে তারা কতটুকু পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে পারছেন এবং না পারলে তার কী কারণ— তা নিয়ে অনেক কথাবার্তা আছে। গণমাধ্যমের অভ্যন্তরেই এ নিয়ে আলোচনা আছে। আছে আত্মসমালোচনা। আছে সীমাবদ্ধতা নিয়ে নিজেদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ। কিন্তু অস্বীকার করার সুযোগ নেই, দিন শেষে গণমাধ্যমই ভরসা।