কিছুদিন আগে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এরপর এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে টানা বিক্ষোভ, সহিংসতা, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ জারি-সব মিলে জীবনযাত্রা অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল। ১৬ থেকে ২১ জুলাই বাংলাদেশে যে নজিরবিহীন বিক্ষোভ আর সহিংস আন্দোলন হয়েছে, তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনোই দেখা যায়নি। এত কম সময়ের মধ্যে দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি এবং অনেকের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যদিওবা কোর্টের রায় ও সামরিক বাহিনীর অবস্থানের মধ্য দিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর এ পরিস্থিতির আপাত অবসান হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে এতগুলো তাজা প্রাণ অকালে ঝরে পড়া এবং এর ফলে তাদের পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। স্বাধীনতা-পরবর্তী এরশাদ সরকারের আমলে মজিদ খান কমিশনের বিরুদ্ধে সূচিত ছাত্র আন্দোলনই আশির দশকজুড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। এছাড়া ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধীর বিচারে জোরালো রাজনৈতিক আন্দোলন, ২০১৮ সালে কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনও ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করায় তৎকালীন শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের এদেশে ছাত্ররাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। ছাত্রদের দাবির মুখেই ইতিহাসে প্রথম এবারই কারফিউর মধ্যেও সর্বোচ্চ আদালতের কার্যক্রম বসেছিল কোটা সংস্কার করতে। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সাধারণ মেধা তালিকা থেকে তা পূরণ করা হবে। প্রকৃতপক্ষে, সরকারি চাকরিতে যোগদানে এখন কোটা পদ্ধতি নেই বললেই চলে। কেননা মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা এখন এর আওতাভুক্ত থাকছে না। তবে রাজনৈতিক চক্রান্তে ছাত্রদের আন্দোলন যে সহিংস রূপ নিল, তা খুবই অপ্রত্যাশিত ছিল। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে নাশকতা করে। টার্গেট করে তাণ্ডব ও অগ্নিসংযোগ চালানো হয় মেট্রো রেলস্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সেতু ভবনসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গোটা যোগাযোগব্যবস্থা, স্থবির হয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতি। ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ মানুষ। মূলত, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো এদেশের মানুষের কষ্টার্জিত অর্থে গড়ে তোলা সম্পদ, মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। এসব ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে একান্তই দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষ।
বিগত কয়েক দিনে উৎপাদনব্যবস্থা, পরিষেবা এবং ব্যবসা খাতে ব্যাঘাতের ফলে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, গত এক সপ্তাহে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তার মতে, চলমান স্থবিরতায় প্রতিদিন অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা।
নাজুক এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এর একটি আন্তর্জাতিক দিক রয়েছে। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সত্য-মিথ্যামিশ্রিত তথ্যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। এটি অদূরভবিষ্যতে বিদেশি বিনিয়োগসহ ভূরাজনৈতিক ও অন্যান্য আর্থিক বিষয়ের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অতি সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটিকে উদাহরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ জুলাই আরব আমিরাতের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ করেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ওই বিক্ষোভের দায়ে ২২ জুলাই ৫৭ বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির সরকার। এর একদিন পরই বাংলাদেশিদের জন্য সাময়িকভাবে ভিসা বন্ধের ঘোষণা দিল দেশটি।