অর্থনীতিকে সচল রাখার পদক্ষেপ জরুরি
কোটাবৈষম্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যৌক্তিক। দেশজুড়ে আন্দোলনের ফলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক কোটা সংস্কার রায়ে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ করা হয়েছে। আন্দোলনকে ঘিরে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসাবে ব্যবহারে কতিপয় সুযোগসন্ধানী অশুভ চক্রান্ত বাস্তবায়নে নজিরবিহীন সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। আন্দোলনকে পুঁজি করে দেশ ও স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসী-জঙ্গি অপশক্তি ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। সচেতন মহলের মতে, ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনায় যারা সম্পৃক্ত ছিল, তারা কোনোভাবেই শিক্ষার্থী হতে পারে না। নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তসাপেক্ষে এসব সহিংসতার উদ্দেশ্য এবং জড়িতদের চিহ্নিত করা অতীব জরুরি। একইসঙ্গে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, যেভাবেই বা যাদের হাতে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তারও সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন। দ্রুততর সময়ের মধ্যে সামগ্রিক বিষয়গুলো আমলে নিয়ে সরকারের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত কাম্য। যে কোনো মৃত্যুই অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। প্রচণ্ড নির্মমতার সঙ্গে হত্যাযজ্ঞের যে চিত্রগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ন্যূনতম বিবেকবান মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সব পক্ষকেই উপলব্ধি করতে হবে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পক্ষ থেকে নানামুখী দাবি উত্থাপন অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে দেশের স্বার্থকে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে আন্দোলনের পন্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। জনগণের জানমাল ও দেশের সার্বিক নিরাপত্তাকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে আন্দোলনের গতিধারা নির্ধারণ কাম্য। ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যেসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হয়েছে, তা দেশবিরোধী শক্তিরই পরিকল্পনার অংশ। সবার মনে রাখা উচিত, রাষ্ট্রের সব সম্পদই জনগণের, তা কখনোই সরকারের হতে পারে না। সর্বস্তরের জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে বিজয়ী দল সরকার গঠন করে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নেবে, এ সাধারণ বিষয়টি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কারও অজানা নয়। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, রাষ্ট্র বা জনগণের সম্পদ সুরক্ষা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতিপ্রবাহ সচল রাখা এবং জনদুর্ভোগ নিরসন করাই সরকারসহ দেশপ্রেমিক সব নাগরিকের ব্রত হওয়া উচিত। যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা। এ লক্ষ্যে নেওয়া যে কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসনীয়।
সবার স্মরণে থাকা উচিত, রাজনৈতিক সংস্কৃতির তাৎপর্যপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে বিভিন্ন দল ও নেতাকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও শিষ্টাচার। সব ধরনের বিরোধ-বিচ্ছেদ পরিহার করে আলাপ-আলোচনা-সমঝোতার পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই সুস্থ রাজনীতির পরিচায়ক। আমরা দেখেছি, অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের হীন উদ্দেশ্যে সবসময় রাজনৈতিক কলহ-বিবাদ জিইয়ে রাখার অপচেষ্টা চলে। মিথ্যাচার, প্রতারণা, জালিয়াতি ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে অনেকে তথাকথিত খুঁটির জোরে বিভিন্ন সংস্থায় ঊর্ধ্বতন পদে আরোহণ করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করেন বলে গুঞ্জন রয়েছে, যা সমগ্র দেশবাসীকে জিম্মি করার শামিল। এসব নষ্ট চরিত্রের মানুষ জনগণের কল্যাণ সাধনের বিপরীতে নানা রকম অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে জনস্বার্থবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। এসব ব্যক্তি সমাজে কম-বেশি চিহ্নিত।
এটি অনস্বীকার্য যে, বৈশ্বিক ও দেশীয় নানা মাত্রিক সমস্যায় দেশের অর্থনীতি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। জনশ্রুতি আছে, কতিপয় সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দুর্বৃত্তায়ন, অদক্ষতা, অযোগ্যতা দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ভূমিকা রাখছে। অধিকাংশ মানুষের জীবনপ্রবাহে প্রতিনিয়ত নাভিশ্বাস দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনায় বড় বড় শিল্পপতিরাও হিমশিম খাচ্ছেন। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচার, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা এবং ঘুস-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ব্যক্তি ছাড়া সাধারণ মানুষ ক্রয়ক্ষমতা হারিয়েছেন। এ পরিস্থিতি দেশে সীমাহীন আয়বৈষম্য তৈরি করেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা ও কারফিউয়ের কারণে অর্থনীতির প্রায় সব খাত কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এতে সংকটে থাকা অর্থনীতি আরও কঠিন সমস্যায় নিপতিত হয়। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা-ফুড ডেলিভারি ও ই-কমার্স থেকে শুরু করে আউটসোর্সিং খাত ক্ষতির মুখে পড়ে। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশের জোগানদাতা তৈরি পোশাক খাতও ক্ষতির সম্মুখীন হয়। চলমান অস্থিরতায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খেলাপি ঋণ আরও বৃদ্ধি পাওয়া এবং এতে ব্যাংকের মুনাফা কমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সচল
- বাংলাদেশের অর্থনীতি