একটি যৌক্তিক আন্দোলনের করুণ পরিণতি
আমাদের এই শ্রমঘন সমাজে জুতসই একটি কাজ খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিজের যোগ্যতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে পছন্দমতো চাকরি করা—মানুষের সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা। শিক্ষাজীবন থেকেই আমাদের সমাজের মানুষ ব্যস্ত থাকে ভবিষ্যতে কী কাজ করবে, কোন ধরনের চাকরি করবে, তা নিয়ে। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি থাকে সরকারি কোনো উচ্চপদে চাকরির জন্য। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা করপোরেশনে চাকরি করার ক্ষেত্রে অধিকতর মেধাবীরা প্রস্তুতি নিতে থাকে শিক্ষাজীবন থেকেই।
এখানে দোষের কিছু নেই, নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলে কেউ যদি যথাযোগ্য চাকরি পায়, তখন সে তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে কর্মক্ষেত্রে, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই।
আমাদের দেশে উল্লিখিত সরকার বা রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে কোটাপ্রথা প্রচলিত আছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ৫৬ শতাংশ জনবল নিয়োগ হতো কোটার বিপরীতে, ৪৬ শতাংশ নিয়োগ হতো মেধার ভিত্তিতে। এই কোটার মধ্যে ৩০ শতাংশ নিয়োগ হতো মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পোষ্যদের মধ্য থেকে। কিন্তু কোনো দিনই এই ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ হতো না, পূরণ না হওয়া পদের সংখ্যাকে মেধার মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হতো না। এখানে যা ক্ষতি হয়েছে—মেধাবীরা চাকরি পায়নি, সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় বছরের পর বছর পদ খালি থেকেছে, কাজের বিঘ্ন ঘটেছে বিভিন্ন সংস্থায়।
২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলন হয়। নির্বাহী বিভাগ থেকে কোটাপ্রথা বাতিল করা হয়। সংস্কার না করে বাতিল করে আমাদের দেশে অনগ্রসর মানুষের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হলো। এই কোটা বাতিলের বিপক্ষে তখন ছাত্ররা কোনো আন্দোলন করল না, কোনো দাবি তুলল না। আন্দোলনকারীরা কি স্বার্থপর ছিল? নিজেদের স্বার্থ হাসিল হওয়ার পরে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা তারা ভুলে গেল?
এই কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনের বিপরীতে হাইকোর্টে মামলা করা হলো। মামলার প্রাথমিক আদেশে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনকে বাতিল করে আদেশ দেওয়া হলো। ছাত্রদের মাঝে অসন্তোষ তৈরি হলো। সরকারপক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা হলো। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের আদেশের কার্যকারিতা স্থিরকরণ করল, অর্থাৎ আদেশের কোনো কার্যকারিতা থাকল না। হাইকোর্ট থেকে পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়ার পরে আপিল বিভাগ একটি দীর্ঘ সময় নিয়ে শুনানির ব্যবস্থা করল। ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ চরম আকার ধারণ করল। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের দুই পর্যায়ের যে আদেশ দেওয়া হলো, সে ব্যাপারে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারল না। বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলো আপিল বিভাগ।
নির্বাহী বিভাগ থেকে ছাত্রদের বোঝাতে ব্যর্থ হলো যে বিচার বিভাগে কোনো ব্যাপারে শুনানি চলমান থাকলে সে ব্যাপারে আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ তাৎক্ষণিক কোনো আইন পাস করতে পারে না। নির্বাহী বিভাগ বা আইন বিভাগের যেকোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিচার বিভাগে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বিচার বিভাগের চূড়ান্ত রায় চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।
এ বছর ১৪ ও ১৫ জুলাই সাধারণ ছাত্র আন্দোলন যখন দানা বাঁধছে, তখন ছাত্রলীগ ও সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ হলো। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ল। যারা কোটা সংস্কারের পক্ষে, তাদের মাঝে বিরোধী রাজনীতি ভর করল। বিরোধী কুচক্রী মহল সুযোগ খুঁজতে থাকল। সরকারের ভাষায়, জামায়াত-শিবির-বিএনপি-ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা সাধারণ ছাত্রদের মাঝে মিশে গিয়ে আন্দোলন বেগবান করার চেষ্টা করল। ১৬, ১৭, ১৮ জুলাইয়ের আন্দোলনে বলতে গেলে সব শ্রেণির ছাত্রই অংশগ্রহণ করল। সেই সুযোগে কুচক্রী মহল অনুপ্রবেশ করল, ভাঙচুর করল রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সরকার জনগণের জানমাল রক্ষার্থে বলপ্রয়োগ করল, ঝরে যেতে থাকল সাধারণ ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের জীবন। কুচক্রী মহল উৎসাহ ফিরে পেল, ধ্বংসযজ্ঞে মেতে গেল অধিক আগ্রহ নিয়ে।
বৃহস্পতিবার ১৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কোটা সংস্কার করে রায় দিল। ছাত্রদের যে দাবি ছিল এই রায় প্রায় তার কাছাকাছি, এককথায় বলতে গেলে ছাত্রদের দাবি পূরণ হলো। শুক্র ও শনিবার ১৯ ও ২০ জুলাই যে আন্দোলন হলো, সেখানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কোনো অংশগ্রহণই ছিল না। এখানে ছাত্র আন্দোলনের রাজনীতির মধ্যে ‘পলিটিকস’ ঢুকে গেল। আরও ঝরে যেতে লাগল অগণিত প্রাণ।