দেশ শুচিশুদ্ধ হয়ে উঠুক

যুগান্তর ড. হাসনান আহমেদ প্রকাশিত: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:৫৪

ছাত্রাবস্থায় একটা কথা কোথায় যেন পড়েছিলাম, স্মৃতির পাতা হাতড়িয়ে মনে করতে পারলাম না। কথার মূল ভাবটা এরকম : রাজনীতি হচ্ছে অসংখ্য মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত অল্পসংখ্যক মানুষের সুবিধার্জনের একটা ব্যবস্থা। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের সময়টার কথা এবং বর্তমান অবস্থার কথা মনে হলেই ভুলে যাওয়া বাক্যটার ভাবার্থটা মাথায় নাড়া দেয়। আমি দেখি, এদেশে এই তেপ্পান্ন বছর ধরে একই প্রবাদ চলছে। তাই অনেক নির্ভেজাল সত্য কথা বলতে গিয়েও ভয়ে চেপে যাই, শেষে কিনা নামের সঙ্গে ‘রাজাকার’ তকমা কেউ যোগ করে দেয়। এটি আমার অকপট স্বীকারোক্তি। জানি এদেশে যারা সক্রিয় রাজনীতি করেন, তাদের অধিকাংশ এক চোখে দেখেন, তারা দুটো চোখ ব্যবহারে অনভ্যস্ত। আমি দুচোখ দিয়ে দেখতে গিয়ে অপরাধ করে ফেলি। আমি গ্রামের মানুষ। গ্রামে এদের বলে একচোখা। এক চোখ দিয়ে কি দুচোখের কাজ চলে? কখনোই না।


স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বয়সে কৈশোরের শেষ প্রান্তে ছিলাম। অনেক কিছুই সামনে ঘটেছে। নিজের চোখে যা দেখেছি, তাকে তো কারও মনগড়া কথায় অস্বীকার করতে পারিনে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে মিছিলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছি। উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের মিছিলে যোগ দিয়ে ‘গাড়ির চাকা ঘুরবে না, দোকানপাট খুলবে না’ উচ্চারণ করা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে একটা তেমাথা রাস্তা। পাশেই করিম নানার বাড়ি। পাশের তেমাথায় বসে অনেকেই করিম নানার কথা শুনতেন। করিম নানা প্রায়ই হাত উঁচু করে নেড়ে নেড়ে পূর্ব-পাকিস্তানের বঞ্চনার কথা উপস্থিত সবাইকে বলতেন। ওইদিন সেখানে কাঙালী ভাই, ফটিক ভাইসহ অনেককেই দেখলাম। ফটিক ভাই, কাঙালী ভাইয়ের মতো আরও অনেকে দিনমজুর। বেশ বেলা হয়ে গেছে, তবুও তেমাথায় বসে স্বাধিকার ও বঞ্চনার কথা বলাবলি হচ্ছে দেখলাম। করিম নানাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘নানা, আজ লাঙলে যাবে না?’ তিনি এক কথায় উত্তর দিলেন, ‘না, আজ হরতাল করব’। এ অজপাড়াগাঁয়ের কোনো এক প্রান্তের কয়েকজন দিনমজুর ও ক্ষুদ্রচাষি কাজে না গেলে পশ্চিম-পাকিস্তানের তক্তে বসে থাকা শাসকদের কাছে যে সে সংবাদটা কোনোদিনই পৌঁছবে না, এ অনুভূতি ওই করিম নানা, ফটিক ভাই, কাঙালী ভাই গং কোনোদিন বুঝে তেমাথায় অবস্থান করেননি। তাদের মনোভাব ছিল, কোনো নেতার কাছে ভালো হওয়ার জন্য নয়, স্বতঃস্ফূর্ত সরল মনের চাওয়া, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই এলাকার দু-একজন রাজাকার বাদে সবাইকেই একজোট হয়ে দল-মত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে যারপরনাই সাহায্য-সহযোগিতা করতে দেখেছি। দেশের কথা, দাবি আদায়ের কথা বলত বলে অধিকাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতেন। সাধারণ মানুষের এ অকুণ্ঠ সর্বাত্মক সমর্থন ও ঐকান্তিক ত্যাগের মানসিকতা ছিল বলে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, নইলে বর্তমান অবস্থায় টাকা ও পদ দিলেই যে অনেক নেতা কিনতে পাওয়া যায়, এমন হলে নয় মাসে দেশ স্বাধীন হতো কিনা সন্দেহ থেকে যায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তারা কোনো সার্টিফিকেটও দাবি করেননি, পানওনি। তাদের সন্তান-সন্ততিরও কাঁচি-মাথাল সম্বল হয়েছে, কেউ এখন ছাত্রছাত্রী। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, স্বাধীনতার পরও ওই ফটিক ভাই, কাঙালী ভাই কমপক্ষে ২৫ বছর বেঁচে ছিলেন। তাদের কোনোদিন অর্ধ-লুঙ্গি ছাড়া পুরো-লুঙ্গি পরে মরতে কেউ দেখেনি।


আমার এক আত্মীয় গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি থেকে খাবার সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াতেন। খানসেনারা তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে গাছে উলটো করে ঝুলিয়ে অমানবিক নির্যাতন করেছিল। তার সঙ্গে আরও অনেককে বধ্যভূমিতে গুলি করতে নিয়ে যাওয়ার সময় এক বিহারি কসাই, যার কাছ থেকে আমার ওই আত্মীয় প্রতিনিয়ত মাংস কিনতেন, তাকে গোপনে ছেড়ে দিয়েছিল। আমার ওই আত্মীয়কে বছরাধিককাল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। আজীবন তিনি ভালোভাবে হাঁটতে পারতেন না। তিনি কোনোদিন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দাবি করেননি। গ্রামের যেসব বাড়ি থেকে প্রতিনিয়ত ভাত-রুটি সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ানো হতো, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করত, তাদের অধিকাংশ পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। যে ক’জন রাজাকার ছিল, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছে, কেউবা অন্য কোথাও পালিয়ে থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কাঙালী ভাই, ফটিক ভাই, করিম নানা গংকে এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের কোনো সুফল পেতে আমি দেখিনি। এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের কর্ম ও পেশার ডাইভার্সিফিকেশনও আমি দেখিনি। কেউ কেউ বড়োজোর চাষ ছেড়ে ছোট্ট দোকান দিয়ে সংসার চালায়। তার এক পুতি নিজের যোগ্যতায় কয়েক বছর হলো একটা চাকরিতে গেছে। আমার প্রশ্ন, আমার দেখা এ মানুষগুলো এবং তাদের পরবর্তী বংশধরদের আমরা মুক্তিযোদ্ধা বলব, নাকি ‘রাজাকার’ বলব? যাদের হাতে সার্টিফিকেট নেই, তারাই কি রাজাকার? অন্যদিকে আমি অনেককেই চিনি, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি, অথচ মামা-খালুর জোরে হাতে সার্টিফিকেট নিয়ে ঘুরছে। তাদের অনেকেই অবসরে গেছে। তাদের সন্তান এবং নাতি-পুতিরা সুবিধা পাচ্ছে। এদের ব্যাপারে রাজনীতিকদের বক্তব্য কী? ইচ্ছাকৃতভাবে ঢালাও কথা বলে মুক্তিযুদ্ধকে কলুষিত করার জন্য মূলত এরাই দায়ী। এরা পানি ঘোলা করে মাছ শিকারে মত্ত। এদের অনেকেই তৎকালীন সহজ-সরল বাঙালিকে কথা দিয়ে কথা রাখেনি। দেশকে নিজের সম্পত্তির মতো নিজেরা ভোগদখল করে চলেছে, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলেছে।


সাধারণ সহজ-সরল মানুষকে বোকা ভাবা ঠিক নয়, তাদের চোখে এটি ভালো লাগে না। তারা প্রতিবাদ করতে পারে না সত্য, কিন্তু ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়। স্বাধীনতায় দেশ ভিনদেশি শোষণমুক্ত হয়েছে, কিন্তু অসংখ্য শোষক স্বয়ং নিজের ঘরে তৈরি হয়েছে, যে কথা আমি প্রায় নিবন্ধেই লিখি। সার্টিফিকেটধারী ও নন-সার্টিফিকেটধারী অনেকের বংশধরদেরও অতি প্রতীক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আশাভঙ্গের বেদনার কারণে বিভিন্ন দলে ঢুকে দলীয় সাপোর্টার বা সক্রিয় রাজনীতিক হতে নিজ চোখে দেখেছি। দোষ কার? যারা শপথ করে ভঙ্গ করেছে, কিংবা কথা দিয়ে কথা রাখেনি তাদের, নাকি পরবর্তী বংশধরদের? যারা সত্যিকার অর্থে ভাবেন, মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, দেশকে ভালোবাসেন, কোনো দলবাজি করেন না, তাদের সঙ্গে কথা বলে নির্ভেজাল সত্যটা জেনে নিলে ভালো হয়। ঢাকার চার দেওয়ালের মধ্যে বসে ‘চাটার দলের’ স্তুতিবাক্য শুনে আমাদের মুখ দিয়ে ‘বেফাঁস’ (অসংযত) কথা যত সংযত করা যায়, দেশের পরিবেশ ও স্থিতিশীলতার জন্য ততই মঙ্গল। নির্ভেজাল দলবাজি, দেশ লুট, ব্যাংক লুট, বাধাহীন দুর্নীতি, আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য-এসব কারণে মানুষ খুব ক্ষোভে ও কষ্টে আছে। স্বাধীনতার পর এমন বিক্ষুব্ধ অবস্থা আমি আর দেখিনি। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে সবই ওপেন-সিক্রেট হয়ে গেছে। এ ক্ষোভের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ হলে দেশের পরিবেশ যারপরনাই খারাপ হবে, এটাই আমরা চোখে দেখলাম। কেউ অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকে না। ‘যা কিছু হারাক ঐ কেষ্ট বেটাই চোর’-এ বচন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আত্মোপলব্ধি থাকতে হবে। ‘কোটা সংস্কার’ আন্দোলন তখন ‘দেশ সংস্কার’ আন্দোলনে রূপ নেওয়াটাও অবাস্তব নয়। পদে উপবিষ্ট লোকজনকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। নইলে ভবিষ্যতে ব্যাপকভাবে মায়ের বুক খালি হয়ে যাবে, আমি দেখতে পাচ্ছি। লিখছি বলেই বিরোধিতা করছি, একথা ভাবার কোনো কারণ নেই।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও