এত মৃত্যুর দায় কার?
সুকুমার রায় জীবনের এক অমোঘ সত্যের কথা তুলে ধরেছেন তাঁর ‘ষোল আনাই মিছে’ ছড়ায়। ছড়াটি বহুল পঠিত। কিন্তু এই ছড়া থেকে বাঙালি কিছু শিখতে পেরেছে বলে মনে হয় না। নইলে দেশে প্রতি বছর এত মানুষ শুধু সাঁতার না জানার কারণে প্রাণ হারায় কী করে! তাই লেখাপড়া শিখে এত পণ্ডিত হয়েও আমাদের জীবনটা থেকে যায় ঝড়ের কবলে পড়া সেই বাবু মশাইয়ের মতো ‘ষোল আনাই মিছে’।
শখেরবশে নৌকায় উঠে বাবু মশাই মাঝিকে জগতের তাবৎ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেন। সূর্য কেন ওঠে, চাঁদা কেন বাড়ে-কমে? কিন্তু মূর্খ মাঝি কি আর এসব জ্ঞানগর্ভ কথার উত্তর দিতে পারেন। তখন বাবু মশাই ভর্ত্সনার স্বরে বৃদ্ধ মাঝিকে বলেন, ‘বলব কি আর বলব তোরে কি তা, / দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।’ এমন সময় নদীতে ঝড় ওঠে। মাঝি বাবুকে জিজ্ঞেস করেন, সাঁতার জান? বাবু না-সূচক মাথা নাড়েন। তখন মাঝি বলেন, ‘বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,/তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে!’
নদীমাতৃক বাংলাদেশ। এ ছাড়া বছরের একটা লম্বা সময় বন্যার পানিতে ডুবে থাকে দেশের বৃহৎ অঞ্চল। তখন নৌযান ছাড়া সেসব অঞ্চলে চলাচল করা যায় না। এই সময়টাতে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা আরো বেশি ঘটে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কেউ বাদ যায় না। অথচ একটু সচেতন হলে, সাঁতার জানলে অনেক বিপদ থেকেই রক্ষা পাওয়া যায়।
শুধু বন্যার সময়ই নয়। সারা বছর ধরেই পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশুসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ৮ জুলাই সোমবার বিকেলে উপজেলার কামরাবাদ ও সাতপোয়া ইউনিয়নে পৃথক এ দুটি ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া শিশুটি হলো সাতপোয়া ইউনিয়নের আদ্রা গ্রামের হেলাল মিয়ার ছেলে ইয়াসিন মিয়া (৮)। মারা যাওয়া অপর ব্যক্তি হলেন কামরাবাদ ইউনিয়নের কামরাবাদ গ্রামের মৃত জমশের আলীর ছেলে শাহা আলী (৫৫)।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ঘটনার দিন বিকেলে বাড়ির পাশে ঝিনাই নদে গোসল করতে যান শাহা আলী। এ সময় বন্যার পানির স্রোতে নদীতে নিখোঁজ হন তিনি। কয়েক ঘণ্টা পর তাঁর লাশ নদীতে ভেসে ওঠে। পরিবারের লোকজন তাঁর লাশ উদ্ধার করেন। এছাড়া সাতপোয়া ইউনিয়নের আদ্রা গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয় শিশু ইয়াসিন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন। এ ধরনের মৃত্যুও ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো সাঁতার শেখাটা কতটা জরুরি। এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি সাঁতার শেখাকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়, যা মোট শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশ। আর প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। বলতে গেলে শিশুর অন্যতম ঘাতক এই পানিতে ডুবে মৃত্যু। প্রশ্ন হচ্ছে এত মৃত্যুর দায়ভার আসলে কার? এই মৃত্যু রোধ করতে হলে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকে। শিশুরা জলাধারের কাছে যাতে যেতে না পারে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে।