আন্দোলনের দ্বারা কি শুধু জনগণই আক্রান্ত হবে
সম্প্রতি কোটাভিত্তিক আন্দোলনে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে জনজীবন দীর্ঘ সময় ধরে স্থবির হয়ে পড়ে। এমনিতেই রাজধানী শহর ঢাকা প্রবল যানজটে আক্রান্ত থাকে। সাধারণ মানুষের কষ্টের শেষ নেই। গত রোববার আমি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখেছি। সমস্ত পথঘাট বন্ধ, জরুরি প্রয়োজনে কোথাও যাওয়ার জো নেই। নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আন্দোলনটি যেহেতু আপাতদৃষ্টিতে সরকারের বিরুদ্ধে, কিন্তু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে আদালত সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে, এই আন্দোলন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে। সংঘাতটা মূলত সরকার বনাম আদালত। সরকার এখানে নিরাপদ অবস্থানে থেকে বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের রায় মান্য করা হবে। কিন্তু এখানে সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বসে একটি সমাধান বের করার চেষ্টা করতে পারত, যাতে জনসাধারণের কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়।
অতীতেও দেখেছি দীর্ঘ ধর্মঘট হয়েছে, হরতাল হয়েছে, অবরোধ হয়েছে। সেসবে সরকার নীরব ভূমিকা পালন করেছে। এই সব হরতাল-ধর্মঘটে মন্ত্রী-আমলা, সরকারের কিছু ক্ষতি হয় না, ক্ষতি হয় জনসাধারণের। কিন্তু দেখা গেছে, লাখ-কোটি টাকা মানুষের লোকসান হয়েছে। মানুষের যেমন লোকসান হয়েছে, তেমনি সরকারেরও লোকসান হয়েছে। কোনো সরকারই জনজীবনের দুর্দশার জন্য উদ্বিগ্ন নয়।
এখন দেখতে পাচ্ছি যে জনগণ এত দুর্ভোগ পোহাচ্ছে, তারাও এত সহনশীল হয়ে গেছে যে আন্দোলনের পক্ষে বা বিপক্ষে তাদের কোনো ভূমিকা নেই।
কোটাকে একটা যৌক্তিক জায়গায় নিয়ে আসা কি খুব কঠিন বিষয়? কোটা পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। কিন্তু ক্যাডার সার্ভিস সব জায়গায় নেই। আর এই ক্যাডার সার্ভিসের জন্য অতীতে কখনো এত বড় আন্দোলন দেখা যায়নি। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য মূলত এই আন্দোলন। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য কোনো উচ্চবাচ্য নেই, সেখানেও তো কোটাপদ্ধতি আছে। তবে হ্যাঁ, মেধার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় পরীক্ষাগুলো হয়, সেখানে কি মেধা বিচারের কোনো অবকাশ থাকে? সম্পূর্ণ মুখস্থবিদ্যার ওপর একটি পদ্ধতিতে এই পরীক্ষাগুলো হয়ে থাকে এবং দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে এই পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনাও মুখ্য হয়ে পড়ে। দেখা যায় কোনো কোনো শাসনামলে ক্যাডার সার্ভিসও প্রভাবিত হয়ে যায়। কবির ভাষায়, ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি’।
ঔপনিবেশিক আমলের প্রভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভাজনে আমাদের দেশে চাকরির বিধিমালা তৈরি হয়। উপমহাদেশে এবং ব্রিটিশ কলোনিগুলোয় এখনো এই চাকরির বিধিমালা বলবৎ আছে। এসবকে প্রভাবিত করে থাকে উচ্চবর্গীয় আমলাতন্ত্র। যেহেতু রাজনীতিবিদেরা এখন পর্যন্ত জ্ঞানে-দক্ষতায় একটা উঁচুমাত্রা অর্জন করতে পারেননি, তাই তাঁদেরও আমলাতন্ত্রের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হয়। জনপ্রতিনিধিরা তাঁদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন নন ও ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে স্বজনপ্রীতি এবং প্রকৃত বিচার করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
যা-ই হোক, যেহেতু আন্দোলনটি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে, তাই সরকারের উচিত হবে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে একটি যৌক্তিক মীমাংসায় পৌঁছানো এবং আদালতকে উপেক্ষা না করে আইনগতভাবে কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়, সেই পথ খুঁজে বের করা।
এদিকে আবার সর্বজনীন পেনশনব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের একটা বড় আন্দোলন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান আছে। এ ক্ষেত্রে আদালতের কোনো ব্যাপার নেই, সম্পূর্ণ বিষয়টি সরকারের হাতে। সর্বজনীন পেনশনের বিষয়টি অবশ্যই আমাদের কাছে নতুন এবং যাঁরা সরকারি কর্মচারী নন, তাঁদের কাছে অবশ্যই আকর্ষণীয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বৈষম্য। বিশুদ্ধ সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে এই বৈষম্য আছে। যেখানে শিক্ষা দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেখানে শিক্ষকেরা যদি অবহেলিত বা নিজেদের উপেক্ষিত মনে করেন, তাহলে তাঁদের আন্দোলন ন্যায়সংগত।