মুঈনুদ্দিনের পক্ষে ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্টের রায়: আমাদের করণীয়
গত ২০ জুন যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত, বিলেতে বসবাসকারী চৌধুরী মুঈনুদ্দিনের দায়ের করা আপিলের উপর রায় দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত, সুপ্রিম কোর্ট, যে আদালত অতীতের হাউজ অব লর্ডসের স্থলাভিষিক্ত (এরপর শুধু ‘সুপ্রিম কোর্ট’ লেখা হবে)। সে রায়ে সুপ্রিম কোর্ট এমন সব কথা বলেছেন যা বস্তুত বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করারই সামিল। আইন অঙ্গনের সঙ্গে পরিচিত নন এমন ব্যক্তিরাও জানেন যে একটি দেশের আদালত অন্য একটি সার্বভৌম দেশের আদালতের রায়ের যথার্থতা যাচাই করার অধিকার রাখেন না। এটি করা সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের সামিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়টি পড়ে মনে হচ্ছে সেটি যেন বাংলাদেশের আদালতসমূহের উপর কর্তৃত্ব চালানোর ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত, যে ক্ষমতা ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশ প্রিভি কাউন্সিলের বিচার বিভাগীয় কমিটির ছিল।
রায়টি শুধু অন্য একটি দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের সামিলই নয়, এতে রয়েছে আমাদের যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিষয়ে অনেক ভ্রান্ত, বাস্তবতাবিবর্জিত বক্তব্য।
সুপ্রিম কোর্ট রায়ের ৬৩ প্যারাতে এমন সব কথার অবতারণা করেছেন, যা বিলেতে পড়াশুনা করা ব্যারিস্টার, সে দেশের আদালতে মামলা পরিচালনা করার, সে দেশের পররাষ্ট্র এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাদের ট্রেনিং সেশনে পদাধিকারবলে প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করা এবং সে দেশের একাধিক শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সটার্নাল ছাত্রদের প্রভাষক হিসাবে বহু বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্ট লিখেছেন, (মুঈনুদ্দিনর) মামলাটি ‘হান্টার’ মামলায় ঘোষিত নীতি থেকে আলাদা এই অর্থে যে ওই সকল মামলায় আসামিরা মামলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার, এবং দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার অবাধ সুযোগ পেয়েছিলেন, যে সুযোগ মইনুদ্দিন পাননি। সুপ্রিম কোর্ট লিখেছেন, “অন্যদিকে আইসিটি (বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল), (মুঈনুদ্দিনর) বিচার করেছিলেন তার অনুপস্থিতিতে। বাস্তবিক অর্থে সেই মামলায় বা পরবর্তী আপিলে তার উপস্থিতি আশা করা যায় না, কেননা (মইনুদ্দিন) সত্যিকার অর্থে মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকিতে ছিলেন। (মুঈনুদ্দিনর) পক্ষে যে কৌসুলি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল দৃশ্যত তিনি মুঈনুদ্দিনের কাছ থেকে তথ্য গ্রহন করতে হয় নারাজ ছিলেন অথবা অক্ষম ছিলেন। এটা স্পষ্ট নয় (মইনুদ্দিন) তার আপিলে কি কি হেতুবাদ প্রদান করতেন, কেননা ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা পদ্ধতিগত নিশ্চয়তা প্রাপ্তির অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যেগুলো বাংলাদেশের সংবিধান এবং বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধি দ্বারা নিশ্চিত। আইসিটি ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য গ্রহণ করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার অধিকারও তার ছিল না। তাছাড়া তিনি আপিলে সফল হলেও তার অর্থ হতো পুনর্বিচার, যাতেও তিনি উপস্থিত থাকতে পারতেন না মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার ভয়ে এবং একইভাবে তখনও সাক্ষ্য আইনের বিধানসমূহ উপেক্ষিত হতো। এ সব কারণে বলা যায় (মইনুদ্দিন) মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পূর্ণ সুযোগ পাননি।”
সুপ্রিম কোর্ট আরো লিখেছেন, “২০১৩ সালে আইসিটি প্রায় ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন, এবং প্রয়াত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের বর্ণনা বিবেচনায় নিয়েছেন। বাস্তব পরিস্থিতিতে এগুলোকে আন্দাজভিত্তিকই বলা যায়।”
সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যের আলোকে বলতে হয় যে তারা এটি উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি যে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট (অতঃপর শুধু আইসিটি) নামে প্রণীত বিশেষ আইনটি ন্যুরেমবার্গ স্টেচুটের আদলেই করা হয়েছিল। বিধিমালাগুলোও ন্যুরেমবার্গ বিধিমালার অনুসরণেই করা হয়। ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের সনদ প্রণেতাগণ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে কিছু কিছু অপরাধী পালাতে সক্ষম হবে, আর সে বিবেচনায় ন্যুরেমবার্গ সনদের ১২ অনুচ্ছেদে প্রচ্ছন্ন ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে, “কোনো আসামিকে পাওয়া না গেলে, অথবা অন্য কোনো কারণে যদি ট্রাইব্যুনাল মনে করে ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাকে বিচারের সম্মুখীন করা উচিত, তা হলে ট্রাইব্যুনাল তার অনুপস্থিতিতেই বিচার করতে পারবে।”
‘পাওয়া না যাওয়া’ বলতে সনদ নিশ্চিতভাবে এমন আসামিদের কথাই বুঝিয়েছে, যাদের গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা যাবে না। সে অর্থে এটা বলার সুযোগ নেই যে আইসিটি আইনে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচার ব্যবস্থা ন্যায় বিচার পরিপন্থী। তদুপরি বাংলাদেশ-ভারত, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ পৃথিবীর অনেক দেশের প্রচলিত আইনে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধান রয়েছে, কিছু শর্ত পূরণ সাপেক্ষে। আইসিটি আইনে আসামির অনুপস্থিতিতে বিচারের বিধান আমাদের প্রচলিত আইন থেকে নয়, বরং ন্যুরেমবার্গ এবং টোকিও সনদের অনুকরণে করা হয়েছে।
ন্যুরেমবার্গ সনদের প্রণেতাগণ এটাও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে বহুল বিস্তৃত গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে অভিযোগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য আইনের প্রচলিত কঠোরতাকে শিথিল করা প্রয়োজন, যাতে তারা আইনের ফাঁক-ফোকর বের করে বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে না পারেন। তাই সনদের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য আইনের টেকনিক্যাল বিধানসমূহ মানতে বাধ্য থাকবেন না। (ট্রাইব্যুনাল) নন-টেকনিক্যাল কার্যবিধি মেনে বিচার করতে পারবেন এবং এমন যে কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারবেন, ট্রাইব্যুনালের দৃষ্টিতে যার সাক্ষ্য মূল্য থাকবে।” এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্রিটিশ ব্যারিস্টার জেফরি রবার্টসন, কে সি, লিখেছেন, ন্যুরেমবার্গ সনদে ‘হিয়ারসে সাক্ষ্য’ গ্রহণের যে বিধান রাখা হয়েছিল তা এ কারণেই যুক্তিসঙ্গত যে এটি না হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য বাদ পাড়ে যেত।
সনদের ২১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ট্রাইব্যুনাল সাধারণভাবে পরিচিত ঘটনার জুডিশিয়াল নোটিশ নিতে পারবেন, সরকারি কাগজপত্র এবং রিপোর্ট বিবেচনায় নিতে পারবেন।
মার্টিন বোরম্যান, ক্রুপ, যিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন এবং রবার্ট লেদের বিচার তাদের অনুপস্থিতিতে হয়েছিল (যদিও পরে জানা গিয়েছিল যে অনেক আগেই বোরম্যানের মৃত্যু ঘটেছে)। আইসিটি আইনেও সে বিধান রয়েছে, তবে তা আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনের অনুসরণে নয়, বরং ন্যুরেমবার্গ এবং টোকিও সনদের আদলে।