সরকারি কর্মচারীদের কত ভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত
সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা—দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন টিআইবি ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, সেখানে উঠে এসেছে এ তথ্য।
বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পক্ষে দুর্নীতি করা সহজ, কারণ ইউনিফর্ম ও অস্ত্র প্রজাতন্ত্রের অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের চেয়ে তাদের দৃশ্যত শক্তিমান হিসেবে হাজির করে। মানুষ তাদের ভয় পায়। সমীহ করে। এই ভয় ও সমীহ কাজে লাগিয়ে অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ওঠে। তবে তার অর্থ এই নয় যে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই দুর্নীতি করে।
টিআইবির এই প্রতিবেদন প্রকাশের বছর দুই আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে একটি খবরে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে (২০১৫-২০২০) দুর্নীতির অভিযোগে দুদক যত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে, তার অর্ধেকই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
রাজধানীর অভিজাত গুলশান-বনানী-বারিধারার মতো এলাকায় হাজার হাজার ফ্ল্যাটের মালিক কারা, সেটির নির্মোহ অনুসন্ধান করলে বেরিয়ে আসবে, এর বিরাট অংশের মালিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা—এ রকম একটি ফ্ল্যাট কিনতে যাঁদের অনেকের পাঁচ বছরের বেতন এক জায়গায় করতে হবে। প্রশ্ন হলো, তাঁরা কীভাবে কোটি কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট, বিঘার পর বিঘা জমি, রিসোর্ট, দামি গাড়ি এমনকি দেশের বাইরেও বাড়ি কেনেন? প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা টিউশন ফি দিয়ে সন্তানদের বিদেশে পড়ান কীভাবে?
গত ২৯ জুন জাতীয় সংসদে অর্থবিলের ওপর আলোচনায় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ দাবি করেছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯০ শতাংশ দুর্নীতিতে জড়িত। তিনি বলেন, কাস্টমসে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের প্রত্যেকের ঢাকা শহরে দুইটা-তিনটা বাড়ি। বন বিভাগে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের দুইটা-তিনটা করে সোনার দোকান।
সংবিধানের ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না।’ অনুপার্জিত আয় মানে এখানে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে। এর পরের অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে: ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’
প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের কত শতাংশ জনগণের সেবার মানসিকতা নিয়ে কাজ করেন, আর কতজন সারাক্ষণ অফিসে বসে উপরি আয়ের চিন্তা করেন এবং নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন—তা নিয়ে প্রশ্নের শেষ নেই। প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদের ভাষায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯০ শতাংশই দুর্নীতিগ্রস্ত?
যদি তাই হয় তাহলে দেশটা চলছে কী করে? মাত্র ১০ শতাংশ সৎলোক কী করে ৯০ শতাংশ খারাপ লোকের সঙ্গে কাজ করেন? সুতরাং এর সঠিক পরিসংখ্যান বা অনুপাত বের করা খুব কঠিন। কেন,না ধরা পড়ার আগপর্যন্ত সবাই ফেরেশতা। সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদও শুদ্ধাচার পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনিও সব সময় নীতি-নৈতিকতার কথা বলতেন।
সম্প্রতি তুমুল আলোচিত ও বিতর্কিত এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমানও নাকি তাঁর সহকর্মী ও সুহৃদদের সব সময় নীতি-নৈতিকতা মেনে চলার পরামর্শ দিতেন। তার মানে এই লোকগুলোর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত না হলে তাঁরা সারা জীবনই সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে দুর্নীতিমুক্ত ভালো মানুষ হিসেবেই পরিচিত হয়ে থাকতেন। এ কারণেই এই প্রশ্ন জনমনে এখন ঘুরপাক খাচ্ছে যে পুলিশ-প্রশাসনসহ দেশের অন্যান্য সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে এ রকম বেনজীর ও মতিউরের সংখ্যা কত এবং যাঁদের নাম আসছে, তাঁরা মোট দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির কত শতাংশ?
একটি দেশে কেন দুর্নীতি হয় এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কেন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ওঠেন বা উঠতে পারেন, তার অনেকগুলো কারণ আছে। কিন্তু কারণ যা-ই থাক, দুর্নীতি প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো কেমন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়—তার ওপর নির্ভর করে ওই দেশে দুর্নীতি কমবে, নাকি বিস্তৃত হবে।