কী ঘটছে এবং কোথায় কী চাল?
কথা ছিল ৪ জুলাই ২০২৪ সকাল ১১টা নাগাদ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আলোচনায় বসবেন আন্দোলনরত শিক্ষকদের সাথে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া তা জানিয়েছিলেন। আমরা এও জেনেছিলাম যে এই আমন্ত্রণ কিংবা বসার বন্দোবস্ত করেছিলেন ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা। সরল মনের মহাসচিব তা জানানোর পর বহু শিক্ষকের মনেই এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল ‘তাই বলে এইভাবে?’ কিন্তু কেন জনাব মহাসচিবের ঠিক এই রাস্তাটাই খোলা ছিল কিংবা কেন তিনি মন্ত্রী মহোদয়কেই ক্যাম্পাসে চায়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেননি সেইসব প্রশ্ন বর্তমান বাংলাদেশে করলেও চলে, না করলেও চলে। সর্বোপরি, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব অবধারিতভাবে যাদের হাতে তারা সরকারেরও উৎকট অনুগত বটে। ১০ বছরে এই পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে এই নেতৃবৃন্দ কী ধরনের ন্যুব্জ আচরণ ক্রমাগত জারি রেখেছেন তা নিয়ে যাদের স্মৃতি জাগরূক আছে তারা এসব প্রশ্নকে নিরর্থকই বিবেচনা করেন।
শিক্ষকদের আন্দোলনে যুক্ত সব শিক্ষকই। আর বলাই বাহুল্য, এতে বিপুল সংখ্যক প্রকাশ্য সরকারি দলের সমর্থক শিক্ষকেরা আছেন। এদের সংখ্যাটা এখন দেশে এত বড় যে কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মানে আনুগত্য প্রদর্শনই কিনা এই প্রশ্নও আমাদের ভাবিত করে। তারপরও কয়েক দিনের ঘটনাক্রমে অন্তত কয়েকটা ছোটবড় ঘটনা ঘটেছে, অনেকেই জানতে শুরু করেছেন আন্দোলনটা আসলে কী নিয়ে। যতই প্রচুর লোক এখনো শিক্ষকবিদ্বেষী গড়গড়া কথা বলুন না কেন, অনেকেই আন্দোলনের যাথার্থ্য সম্বন্ধে আগের থেকে অনেক বেশি বুঝতে শুরু করেছেন। শিক্ষার্থীদের কিছু অংশ যারা বৃহত্তর সমস্যাগুলো নিয়ে কয়েক বছর ধরে ভাবিত তারা এই আন্দোলনকে নিয়ে নিজেদের অবস্থান বলবার দায়িত্ব বোধ করতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ এমনকি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তাদের ‘কোটাসংস্কার আন্দোলনের’ পক্ষে শিক্ষকদের অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়ার কারণ খুঁজে পেয়েছেন। সর্বোপরি, সরকার সেই চিরপুরাতন ফর্মুলাতে এই আন্দোলন থেকে বিরোধী দল সুফল নিতে চাইছে বলে প্রোপাগান্ডাটা চালু করার মতো গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। সব মিলে পরিস্থিতি অতটা গৌণ নয়। একদম গোপন দানে (দাবার দান অর্থেও, অনুদান অর্থেও) নেতৃবৃন্দ বা একাংশ কুপোকাত হয়ে না গেলে খুব একটা গলি আর খোলা নেই যেখানে এরা আন্দোলনকারী অংশ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য ঢুকে পড়তে পারবেন।
এতকিছুর পরও ‘প্রত্যয় স্কিম’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আপত্তির জায়গাগুলো অনেক কৌতূহলী নাগরিকও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শেষ কয়দিনে কিছু দৈনিক একদম হিসাবনিকাশ করে শিক্ষকদের ক্ষতির বিবরণী প্রকাশ করাতে কিছুটা সুবিধা হয়েছে। অন্তত এই ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের একাংশ মনোযোগী বিশ্লেষণ করেছেন ও উপাত্ত ছেড়েছেন। তারা ও পত্রিকাগুলো এই কৃতজ্ঞতা সব শিক্ষকের কাছ থেকেই পাবেন। তবে এই না বুঝতে পারার কিছু দায় আন্দোলনরত শিক্ষকদের নেতৃবৃন্দের আছে বলে আমি মনে করি। খুব স্পষ্টভাবে মনে করি। গোড়াতেই নেতৃবৃন্দ এই স্কিমকে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে এসেছেন। আর তাতে এমন একটা বাতাসি তুলনা মনে জাগ্রত হতে পারে যে তুলনাটা কার সাথে করা হবে তার দিকনির্দেশনা নেই। বস্তুত, এই স্কিমটাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আবশ্যিক করে ঘোষণা দেওয়াটা প্রতারণামূলক, বরখেলাপমূলক ও চালিয়াতিমূলক। প্রতারণামূলক কারণ সরকারের সম্প্রচারে (বা প্রোপাগান্ডাতে) মনে হবে যেন বা সব স্বায়ত্তশাসিত এবং/বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অবসরপ্রাপ্তদের বিধিবদ্ধ সুবিধাদি এক রকমের, সমধর্মী। বাস্তবে একেবারেই তা নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের (শিক্ষকসমেত) অবসরকালীন সুবিধাদি স্বতন্ত্রভাবে লিপিবদ্ধ ও চর্চিত আছে। তা আর পাঁচটা দেশের তুলনায় ভালো কিনা (তা তো বেতন বলতেও শ্রীলঙ্কার কলিগের কাছেই লজ্জা লাগে আমাদের) সেইটা আরেক প্রশ্ন, কিন্তু বিদ্যমান বেতন কাঠামোর সাথে আনুপাতিকভাবে স্বতন্ত্র ছিল সেটাই বলছি। স্কিমটাকে আবশ্যিক করা বরখেলাপমূলকও বটে। কারণ, যে লিখিত চুক্তি ও অলিখিত ‘প্রত্যয়’ রাষ্ট্রচালক হিসেবে সরকারের/সরকারসমূহের সাথে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিল, সেই চুক্তি ও প্রত্যয়ের/আস্থার বরখেলাপ হয়েছে এই উদ্যোগে। কৌতুকের যে হয়েছে ‘প্রত্যয়’ নামের একটা স্কিম দিয়ে। এটা চালিয়াতিমূলকও বটে। সংখ্যায় ও শিক্ষা গুরুত্বে এত বড় একটা পেশার লোকজনের সাথে আগাম কোনোরকম আলোচনা না করে (যতই লোকদেখানো আলোচনা হোক না কেন) এরকম স্কিমের আবশ্যিক প্রয়োগ চালিয়াতি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে অভিযোগ সরকারের এবং স্কিমটির বিরুদ্ধে করার কথা সেই অভিযোগের স্পষ্টতার অভাবে একটা বাতাসি পদপ্রয়োগ করে পরিস্থিতিটাকে বুঝতে দিতে যথেষ্ট পারঙ্গমতা আমাদের নেতারা দেখাননি। ‘বৈষম্যটা’ কোথায় হলো এবং কীসের সাপেক্ষে তা দু-চার শব্দে বোঝানোর জন্য ‘পাঞ্চলাইন অভিযোগ’ ভিন্ন হতে হতো। উপরন্তু, যেসব প্রতিষ্ঠানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এযাবৎকাল-পর্যন্ত-সংগঠিত অবসর ভাতাদির বন্দোবস্ত ছিল না, সেইখানে এই স্কিমটির সুফল থাকতে যে পারে সেই উল্লেখটিও জরুরি ছিল শিক্ষকদের পক্ষে। সুফল থাকতে পারে বলতে, অবশ্যই ধরে নিতে হবে আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার প্রতি দেশবাসী আস্থাশীল। বাস্তবে বর্তমান সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে আস্থাশীল লোক সরকারি দলের অনুসারীদের মধ্যেও আছে কিনা তা গোপনে গুণে দেখতে হবে। কিন্তু, বলতে চাইলাম, ভালো হৃদয়ের ব্যবস্থাপকেরা আর্থিক দেখভাল করছেন ধরে নিলে, ‘প্রত্যয়’ স্কিমটাও সততার সাথে প্রতিপালিত হবে ধরে নিলে, এই স্কিমটার কিছু লাভপ্রাপ্ত গোষ্ঠীও থাকতে পারে।