শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলন, তবু কিছু প্রশ্ন
গত বছর গুজরাটে গিয়েছি একটা সম্মেলনে। সেখানকার ন্যাশনাল ল স্কুলের উপাচার্য সঞ্জীবী সনৎকুমার আমার বন্ধু মানুষ। তাঁর আমন্ত্রণে পরিবেশ আইনবিষয়ক এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন সার্ক অঞ্চলের আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। একসঙ্গে কিছুদিন থাকলে নানা ধরনের আলাপ হয়, আমাদেরও হলো। একদিন দার্জিলিংয়ের নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষক জানতে চাইলেন বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল সম্পর্কে।
এসব বিষয়ে বিশদ আলোচনায় আমার আগ্রহ নেই। আমি শুধু সিলেকশন গ্রেড (সিনিয়র) অধ্যাপক হিসেবে আমার বেতনের কথা বললাম। তাঁরা বিস্মিত হলেন, আমি হলাম অপ্রস্তুত। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য রয়েছে বিশেষ বেতন স্কেল, সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় তাঁদের বেতন প্রায় দেড় গুণ। আমাদের এখানে উল্টো অবস্থা কেন!
আমাদের দেশে (অন্যান্য দেশেও) শিক্ষকদের অনুমতি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এটিও গ্রহণ করতে পারেন না সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বসবাস করছি দুই যুগ ধরে। নিজের চোখে দেখি, বাড়তি উপার্জনের সুযোগ নেই বলে অনেক শিক্ষকের করুণ অবস্থা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকের কথাই শুধু বলি। দুর্মূল্যের এই বাজারে তাঁদের বেসিক বেতন মাত্র ২৩ হাজার ১০০ টাকা, নানা ভাতা ও কর্তন সমন্বয় করে এর সর্বমোট পরিমাণ সাড়ে ৩৪ হাজারের মতো।
ঘটা করে এসব বলছি প্রত্যয় নামের সরকারের সর্বজনীন পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তের কারণে। এখনকার পেনশন-ব্যবস্থা বাতিল করে ১ জুলাই থেকে এটি বাস্তবায়িত করা হলে নতুন নিয়োগ পাওয়া প্রভাষকদের এই ২২ হাজার টাকা বেতনেরও ১০ শতাংশ কেটে রাখা হবে পেনশনের অংশ হিসেবে।
এটা বর্তমানের বিপদ। ভবিষ্যৎ বিপদ আরও বেশি। তাঁরা গ্র্যাচুইটি পাবেন না, গবেষণা, উৎসব বা অন্যান্য ভাতা পাবেন কি না, তা ঠিক নেই। এক যা সান্ত্বনা চাকরির বয়সসীমা, সেটা ৫ বছর কমে যাবে কি না, সেই অনিশ্চয়তাও রয়েছে। বর্তমানের চেয়ে তাঁরা আড়াই গুণ বেশি পেনশন পাবেন বটে, কিন্তু তা ৩৫ থেকে ৪০ বছর পর, মূল্যস্ফীতি হিসাব করলে এই টাকার মূল্যমান বরং কমে যাবে আরও।
এসব বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রত্যয় পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বাতিল ও অন্যান্য দাবির (যেমন সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশের মতো স্বতন্ত্র বেতন স্কেল) আন্দোলন যৌক্তিক মনে না হওয়ার কারণ নেই।
গত দেড় দশকে পছন্দমাফিক নিয়োগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতিগুলোর একচেটিয়া নেতৃত্বে রয়েছেন সরকারপন্থী শিক্ষকেরা। তাঁদেরই নেতৃত্বে প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বাতিলের আন্দোলনে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অংশ নিচ্ছেন। তাঁদের সর্বাত্মক ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
এই পেনশন স্কিম একইভাবে প্রযোজ্য হতে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের ক্ষেত্রে। পত্রিকার সংবাদ অনুসারে এই স্কিম নিয়ে ক্ষোভ আছে তাঁদের মধ্যেও। কিন্তু শিক্ষকদের তুলনায় তাঁদের স্বাধীনতা নেই, ক্ষোভ বা আপত্তি প্রকাশের সুযোগও অনেকটা নেই আর দেশে। শিক্ষকদের এমন একটা যৌক্তিক আন্দোলনে অন্যদের হয়তো এ কারণে প্রকাশ্যে সমর্থন দেখা যাচ্ছে না।
তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, সমর্থনের পাশাপাশি সেখানে শিক্ষকদের এই আন্দোলন নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের শ্লেষ ও সমালোচনাও। এসব সমালোচনা এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন হবে না বলে আমি মনে করি।