এ সময় বিচ্ছিন্নতার
আমার এ সময় বিচ্ছিন্নতার সময়। এটাতো স্বাভাবিক যে মানুষ পেছনের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে বোঝে, আমিও পেছনের দিকে তাকিয়ে বুঝছি ঘটনাকে। বুঝছি অভিজ্ঞতর হচ্ছি। আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে তিনটি জাতির মধ্যে জীবনযাপন করার। ব্রিটিশের রাষ্ট্র, পাকিস্তানের রাষ্ট্র, বাংলাদেশের রাষ্ট্র।
তিনটি রাষ্ট্র ভিন্ন—আকৃতিতে ভিন্ন, ভাষায় ভিন্ন, নাম ভিন্ন। সেই তিন রাষ্ট্রের মধ্যে উন্নয়ন হয়েছে, সেই উন্নয়নের কথা আমাকে বলতে হবে কিছুক্ষণ। উন্নয়নের ধারা রক্ষিত হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র ভেঙেছে। কিন্তু উন্নয়নের ধারাটা ভাঙেনি এবং সেই ধারাটা হচ্ছে পুঁজিবাদী ধারা। এটা হচ্ছে বাস্তবতা।
আমরা যেটা দেখলাম—ব্রিটিশ আমলে আমরা উপনিবেশ ছিলাম, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ একটা উপনিবেশ ছিলাম। সেই রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই ভেঙে পড়েছে। হুরমুড় করে ভেঙে পড়ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষ।
তারপরে বাংলাদেশে যে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র আমরা দেখেছি, সেখানেও কিন্তু একটা উপনিবেশিকতা দেখেছি। এই রাষ্ট্রীয় উপনিবেশের যে চরিত্র বা উপনিবেশিকরা যা করে, সেটা তো আমরা জানি—তারা লুণ্ঠন করে, শোষণ করে, লুণ্ঠনের মধ্যে দিয়ে যা পায় সেটা পাচার করে দেয়। বাংলাদেশেও এটা চলছে।
যেখানে ধনীরা ধন উপার্জন করে—শ্রম দিয়ে নয়, যারা শ্রম দিয়েছে তাদের শ্রমের বিত্ত অপহরণ করে। এটি ঘটেছে লুণ্ঠনের মাধ্যমে—ব্যাংক লুণ্ঠনের মাধ্যমে, জমি দখল-ভূমিদস্যুতা, নদীদস্যুতা, বৃক্ষদস্যুতার মাধ্যমে। বাংলাদেশের এমপি-মন্ত্রীরা পুঁজিবাদী দীক্ষায় দীক্ষিত। তারা উপনিবেশিকতার চর্চা করে চলেছেন।
আমি যদি শৈশবে ফিরে যাই তাহলে বলতে হয়, আমাদের শৈশব ছিল বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। একেবারে আক্ষরিক অর্থে অন্ধকার। আমাদের এলাকার—বিক্রমপুরের—অনেক খ্যাতি রয়েছে, অনেক বিখ্যাত জ্ঞানী-মনীষী জন্মগ্রহণ করেছেন। আমিও এখানে জন্মগ্রহণ করেছি। কিন্তু এই এলাকার মানুষ অত্যন্ত দরিদ্র। এটা নিচু এলাকা। এখানে ফসল ভালো হয় না। তাই এখানের মানুষের একমাত্র উপজীব্য চাকরি। সে জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। সেই কারণে বিক্রমপুরের মানুষ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু সকলে শিক্ষা পায়নি। এই শিক্ষাটা ছিল অল্প মানুষের জন্য।
আমার শৈশব যে এলাকায় কেটেছে—একটি প্রান্তিক জায়গা নিয়ে আড়িয়াল বিল—একেবারে শেষ জায়গাতে আমরা ছিলাম। বিশ্বযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছয়-সাত বছর হবে। এখানে দুর্ভিক্ষের কথা শুনেছেন অনেকে। আমরাও জানি এবং সেই দুর্ভিক্ষ ছিল পঞ্চাশের মন্বন্তর। আমরা জানি সেখানে ৩৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সেই দুর্ভিক্ষে আমরা প্রান্তিক মানুষ কোনো রকমে বেঁচেছি।
আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন এবং তিনি যখন যেরকম টাকা পাঠাতে পারতেন, সেরকম জীবন চলতো। খুবই সাধারণ জীবনযাপন ছিল। স্কুল ছিল না। আমরা যাওয়ার পরে প্রাইমারি স্কুল হয়েছে সেখানে।
এর মাঝে একদিন শুনলাম, একজন ফাঁসি দিয়েছেন। আমরা দেখলাম একটি গাছের সঙ্গে মানুষ ঝুলছে। সেই মানুষ পুতুলের মতো ঝুলছে আর বাতাসে লাশ নড়ছে। সেই প্রথম অভিজ্ঞতা। তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি। এই মানুষটি নিঃস্ব ছিলেন। অনাহারে অসহায় অবস্থায় হতাশ হয়ে ফাঁসি দিয়েছেন। যে হতাশার কথা বাংলাদেশে আজও শুনি। আমার কাছে ব্রিটিশ শাসনের ছবি ওই আত্মহত্যার ছবি। এটা ওই শাসনের রূপক।
তারপরে আমরা স্বাধীন হলাম। পাকিস্তান হলো। পাকিস্তান অর্থ দাঁড়ালো দেশভাগ। এই দেশ ভাগের মধ্যে আমরা যেটা দেখলাম সেটা হচ্ছে, এই ভাগ যে কত ক্ষতিকর হয়েছে তখন আমরা উপলব্ধি করিনি। এখন উপলব্ধি করি, ওই যে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়, তারপরের বড় দুর্ঘটনার নামই '৪৭ এর দেশভাগ। '৪৭ এ যখন দেশ ভাগ হয় হঠাৎ করে, আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।