সাদিক অ্যাগ্রো ও আলাদিনের চেরাগের ইতিবৃত্ত
বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা আর খাসির মাংসের কেজি ১১-১২শ টাকা। সাধারণ মানুষের পাতে যখন মাংসের টুকরো মেলা ভার; মলিন মুখে বাজারে বাজারে ঘোরা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে গরু বা খাসির মাংস; তখন কোরবানির ঈদে একটি ছাগল ১৫ লাখ টাকায় কিনতে গিয়ে সদ্য সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের পুত্র মুশফিকুর রহমান ইফাত অজানা সুড়ঙ্গের তালা খুলে দিয়েছে। কল্পনার যাবতীয় সীমা ছাড়িয়েছে তার পিতার সম্পদের পাহাড়। বছরের পর বছর অনিয়মের অলিগলিতে গড়ে তোলা সেই হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির বিবরণী কেউ জানতেই পারত না, যদি মতিউরের ‘পশুপ্রেমী’ পুত্রের ১৫ লাখি ছাগলের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল না হতো। এক ভিডিওতে ‘বেহুঁশ’ অনৈতিকতা ‘চিচিং ফাঁক’ হওয়ার পরই কেবল নড়েচড়ে বসে প্রশাসন যন্ত্র।
খোদ রাজধানীর হৃৎপিণ্ডে রামচন্দ্রপুর খাল দখল করে সাদিক অ্যাগ্রোর সুবিশাল খামার গড়ে উঠেছিল; সেখানে লাখ কোটি টাকা মূল্যের গরু, ছাগলের সুবিশাল মজুত তৈরি হয়েছে। দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বছরের পর বছর সেখান থেকে নধরকান্তি পশু কিনেছেন; চোখ ধাঁধানো দামের কথা মহোৎসাহে ফেসবুকে-টেলিভিশনে উচ্চকণ্ঠে প্রচারও করে যাচ্ছিলেন সাদিক অ্যাগ্রোর কর্ণধার; কোটি টাকার গরু আর লাখ টাকার ছাগলের গল্প শুনে রূপকথার আবেশও পাচ্ছিল আমজনতা। কোথা থেকে ইফাতের ১৫ লাখি ছাগল দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে একের পর এক তিতে সত্য ফাঁস করে দিচ্ছে!
ছাগলের দাম নিয়ে জল অনেক ঘোলা হওয়ার পর সমকাল জানাচ্ছে, সিটি করপোরেশনের অভিযানের তৃতীয় দিন ‘রাজধানীর মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ এলাকার সাদিক অ্যাগ্রোর পুরো খামার গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে’ (৩০ জুন ২০২৪)।
দেখা যাচ্ছে, খামার করতে যেসব অনুমতির দরকার পড়ে, তার কিছুই ছিল না সাদিক অ্যাগ্রোর। মোহাম্মদপুর এলাকায় খামারটি রামচন্দ্রপুর খালের পাড় ঘেঁষে ছিল। অথচ খালের প্লাবনভূমির ৩০ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। স্থাপনা নির্মাণের জন্য রাজউকের কোনো অনুমতিও ছিল না। এমনকি খামারের জন্য নেওয়া হয়নি ট্রেড লাইসেন্সের মতো প্রাথমিক অনুমতিপত্র।
নিভৃত পল্লির অচেনা কোনো প্রান্তে নয়, রাজউকের নাকের ডগায় খাল দখল করে অনুমোদনহীন খামার গড়ে বছরের পর বছর উচ্চমূল্যের গরু-ছাগল বিক্রির মচ্ছব বসিয়েছিল সাদিক অ্যাগ্রো। জীবনানন্দ দাশ বেঁচে থাকলে হয়তো সিটি করপোরেশনকেই প্রশ্ন করতেন, এতদিন কোথায় ছিলেন?
রাজউক বা সিটি করপোরেশনের আসল কাজ সম্ভবত অপরাধীদের আড়ালে রাখা। নইলে রাজধানীজুড়ে একের পর এক খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ যজ্ঞ চললেও তারা বিন্দুমাত্র টের পায় না কেন? লাইসেন্স ছাড়া একের পর এক গরু-ছাগলের খামার গড়ে ওঠে, তাদের সুখনিদ্রা ভঙ্গ হয় না। পরিবেশকর্মীরা নিয়মিতভাবে খাল দখলের বিরুদ্ধে সোচ্চার; রাজধানীতে জলাভূমির প্রয়োজনীয়তার কথা বিশদভাবে বলা হয় বারবার; কিন্তু সকলই গরল ভেল! দখল হতে হতে রাজধানীর বেশির ভাগ খালই নালায় পরিণত হয়েছে।
২.
সাদিক অ্যাগ্রো কি ঢাকা শহরে একটিই? রামচন্দ্রপুর খালই কি কেবল দখল হয়েছে? রাজধানীর খাল দখল নিয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম দেখা যাক: ক. অবৈধ দখলকৃত ‘শ্যামপুর খাল’ নিয়ন্ত্রণে নিল জেলা প্রশাসন (প্রথম আলো, ২২ মে, ২০২৪); খ. কয়েকটি খাল দখল করে অনেকে হাজারো কোটি টাকার মালিক, (প্রথম আলো, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪); গ. সবুজ ও জলাশয় ৩১ শতাংশই দখল (যুগান্তর, ৪ মে ২০২৪); ঘ. ‘কাল’ হচ্ছে খাল দখল (সমকাল, ২ মার্চ ২০২৪)।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অনুমোদনহীন
- বাণিজ্যিক খামার