মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রবৃদ্ধি বাড়াবে এবারের বাজেট?
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ৬ জুন ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব সংসদে পেশ করেছেন। এটিকে ‘সংকোচনমূলক বাজেট’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য ঘোষিত হয়েছে অর্থনীতিতে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা। আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলংকা ও ভারত তাদের মূল্যস্ফীতির হারকে এরই মধ্যে ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে ফেলেছে, অথচ আমরা পারিনি প্রধানত এ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অদক্ষ ও অর্থনীতি সম্পর্কে কম জ্ঞানসম্পন্ন সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের নিষ্ক্রিয়তা, কায়েমি স্বার্থ ও অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে। এখন অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, যিনি ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদানের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেছেন দুই বছর। কূটনীতিকের চাকরি পরিত্যাগ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করায় তিনি এ দেশের একজন ‘সূর্যসন্তান’ হিসেবে সম্মানের পাত্র। গত সংসদীয় মেয়াদে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। অতএব চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল থাকার কথা। তার বাজেট বক্তৃতাকে আমি প্রশংসা করব অর্থনীতির চলমান সমস্যাগুলোর বাস্তবানুগ স্বীকারোক্তি হিসেবে। সাবেক অর্থমন্ত্রী জনগণের কাছ থেকে বাস্তবতাকে আড়াল করার যে প্রবণতা তার ‘গিমিকে ভরা বাজেট উপস্থাপনায়’ দেখিয়ে যেতেন এবারের বাজেট বক্তৃতায় সেখান থেকে অনেকখানি সরে এসেছে। তবে ওয়াকিবহাল মহল বাজেট প্রস্তাবকে যেভাবে ‘গতানুগতিক’ বলে সমালোচনা করছেন তাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। এর মানে, ওয়াকিবহাল মহল বাজেটে আরো অনেক বেশি সাহসী নতুন নীতিমালা আশা করেছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পুঁজি পাচার, খেলাপি ঋণ, হুন্ডি-দমন ও দুর্নীতিসম্পর্কিত বিষয়গুলোয়। কারণ অর্থনীতি বর্তমানে যেসব সমস্যায় জর্জরিত তার বেশির ভাগই সাবেক অর্থমন্ত্রীর ভুলের খেসারত বলাই সমীচীন। (অবশ্য আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীই সব নীতি গ্রহণ করে থাকেন বলে মনে করা হয়)! এগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য আরো সাহসী ও উদ্ভাবনমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত বাজেটকে সংকোচনমূলক বলা হলে তা যথাযথ বলা হবে, কারণ গত অর্থবছরের ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকার বাজেটের তুলনায় মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় আগামী অর্থবছরের বাজেটটি ‘ক্ষুদ্রতর আকারের’। সামষ্টিক অর্থনীতির তত্ত্বে এটাকে সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি অভিহিত করা হয়, যেখানে সরকারি ব্যয়কে কমিয়ে ফেলা হয় মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সামষ্টিক চাহিদাকে হ্রাস করার জন্য। এদিক থেকে বিবেচনা করলে সরকারি ব্যয়সংকোচন অত্যন্ত সময়োচিত প্রস্তাব। এখানে সরাসরি সংঘর্ষ বাধবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকেও বর্তমান ৫ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে আগামী অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ উন্নীত করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে। (বিশ্বব্যাংক প্রক্ষেপণ করেছে, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ)। আমার বিশ্বাস, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে ৬ শতাংশের ওপরে নিয়ে যাওয়া বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হবে। অবশ্য এ উদ্দেশ্য একেবারে অসম্ভব না-ও হতে পারে কতগুলো বিষয় বিবেচনা করলে। সরকারি ব্যয় এখন দেশের মোট জিডিপির ১৪ দশমিক ৫ শতাংশের মতো, যার মধ্যে সরকারি রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত হলো মাত্র সাড়ে ৮ শতাংশের মতো। বাকি সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ ছিল বাজেট ঘাটতি। এ বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য আমাদের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সূত্র ও বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ করতে হয়েছে। গত অর্থবছরে বৈদেশিক সূত্রগুলো থেকে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ ঋণ পাইনি। তাছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রীর অযোগ্যতার কারণে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতও ছিল বেশ কয়েক বছর ধরে ক্রমহ্রাসমান। এখন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত সর্বনিম্ন। এটা চলতে দেয়া যায় না। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতকে কমপক্ষে ১২ শতাংশে উন্নীত করাটা এখন আমাদের জন্য ‘ফরজ’ হয়ে গেছে বলা উচিত। আগামী অর্থবছরে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতকে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে বাড়ানোর এবং বাজেট ঘাটতি-জিডিপির অনুপাতকে ৪.৬ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী, আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই। এটা অত্যন্ত কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে নিঃসন্দেহে, কিন্তু এটা সঠিক পদক্ষেপ। এ ব্যাপারে আমাদের সফল হতেই হবে। এ দেশে যাদের কর দেয়ার ক্ষমতা আছে তারা দুর্নীতির সহায়তায় কর ফাঁকি দিয়ে চলেছে, এটা চলতে দেয়া যায় না। সাবেক অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ী ছিলেন, তাই তিনি প্রধানত ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেয়ার জন্য এ ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে অনীহ ছিলেন।
এবারের বাজেটে অনেকগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। মোবাইল টেলিফোনে কথা বলার ওপর কর বাড়ানো হয়েছে, মোবাইল সিমের খরচ বাড়ানো হয়েছে, ফ্রিজ, এসি ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ওপর আরোপিত কর বাড়ানো হয়েছে, সব ধরনের সফট ড্রিংকসের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে, আইসক্রিমের ওপর আরোপিত কর বাড়ানো হয়েছে, সিগারেটের ওপর আরোপিত কর বাড়ানো হয়েছে, গাড়ি আমদানির ওপর শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে, ২৫০ সিসির বেশি ক্যাপাসিটির মোটরসাইকেলের শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, কাজুবাদামের ওপর আরোপিত কর বাড়ানো হয়েছে, সংসদ সদস্যদের আমদানীকৃত গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, গিফটের ওপর কর আরোপিত হয়েছে, বিনোদন পার্কে ভ্রমণের ওপর কর আরোপিত হয়েছে। এর বিপরীতে অনেকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরোপিত কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশে নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয়। তবে করপোরেশন ইনকাম ট্যাক্সে প্রদত্ত সুবিধাগুলো এবার না দিলেই ভালো হতো। ব্যক্তিগত আয়করের সর্বনিম্ন সীমা অপরিবর্তিত রাখা হলেও সর্বোচ্চ আয়করের হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি মনে করি, আয়করের জালকে প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে আরো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ভাল হতো। আর একটা ব্যাপার আমার কাছে কখনই গ্রহণযোগ্য মনে হয় না, সেটা হলো কালো টাকাকে সাদা করার ব্যাপারটা। যেখানে সর্বোচ্চ আয়কর হার প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০ শতাংশ, সেখানে মাত্র ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকাকে বিনা প্রশ্নে সাদা করার ব্যবস্থার প্রস্তাব করা কতখানি ‘নৈতিক’ হয়েছে সে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
বাজেটের দুটো বাজে দিক হলো শিক্ষা খাতের বাজেটকে এবার জিডিপির ১ দশমিক ৬৯ শতাংশে নামিয়ে ফেলার প্রস্তাব করা হয়েছে এবং জিডিপির শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বরাদ্দকেও গত বছরের চেয়ে কমিয়ে ফেলা হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়েছিল তখন শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় ছিল ২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, যা ধীরে ধীরে বেড়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছিল ২০১৬ সালে। তারপর থেকে ক্রমেই এ ব্যয় বরাদ্দ জিডিপির শতাংশ হিসেবে কমছে। ইউনেস্কোর কাছে বাংলাদেশ অঙ্গীকার করেছে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে জিডিপির ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। ভারতে শিক্ষা খাতে সরকারি ব্যয় এরই মধ্যে ৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে। টাকার অংকে এ দুই খাতের বাজেট বরাদ্দ গত বছরের চেয়ে বেশি দেখানো হলেও মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় তা প্রকৃতপক্ষে কম। যোগাযোগ ও পরিবহন খাত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এবং পল্লী উন্নয়ন খাতে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে টাকার অংকে।