কেমন যাবে নতুন অর্থবছর?
অর্থবিল ও প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগমুহূর্তে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, বড় কোনো সংশোধনী ছাড়াই সংসদে অনুমোদিত হতে যাচ্ছে বাজেট। সংসদ সদস্যরা অনেক বছর ধরে শুল্কমুক্তভাবে গাড়ি আমদানির যে সুযোগ পেয়ে আসছেন, সেখানেও নাকি কোনো পরিবর্তন আসছে না। ন্যায়সংগতভাবে কর-শুল্ক প্রদানে সব শ্রেণির নাগরিককে উৎসাহিত করতে এ ক্ষেত্রে কিছু শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন নতুন অর্থমন্ত্রী। তারা নিজেরা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন বলেও অর্থমন্ত্রী আশা করেছিলেন। সেটা হয়েছিল প্রশংসিত। আমরা নিশ্চয় আরও প্রশংসা করতে পারতাম, যদি সত্যি সত্যিই এ ক্ষেত্রে কিছু শুল্ক অন্তত আরোপিত হতো। সাধারণভাবে গাড়ি আমদানিতে কিন্তু উচ্চ থেকে অতি উচ্চ হারে শুল্ক আরোপিত রয়েছে।
বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে কর-শুল্ক আরোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা নিয়ে ব্যবসায়ীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতেও প্রশ্ন ওঠে। বিনিয়োগ, বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাসের এ সময়ে এটা আরও নেতিবাচক প্রভাব রাখবে বলে সমালোচনা হয়। বলা হয়, পাইপলাইনে থাকা বিনিয়োগও প্রত্যাহার হবে তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে। বেজার সঙ্গে আলোচনা না করেই এনবিআর এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও জানা যায়। পরে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত হয়েছে এ নিয়ে দেনদরবার। তাতে সুফল মিলেছে বলেই জানা যাচ্ছে। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর অব্যাহতি বহাল থাকলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কতটা বাড়ে, সেদিকেও লক্ষ্য থাকবে আমাদের। দেশে মানসম্মত কাজের সুযোগও বাড়া দরকার। ওই ধরনের বিনিয়োগে সেটা নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ বেশি।
আমদানি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে শ্লথগতি চলার সময় এনবিআরকে অবশ্য বড় রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে চলেছে সরকার। সেটি পূরণ করতে গিয়ে সংস্থাটি মাঝেমধ্যেই অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে যেখান থেকে সহজে ও নিশ্চিতভাবে রাজস্ব আসবে, সেখানে গিয়ে হানা দিচ্ছে। সেলফোন ব্যবহারে আরোপিত উচ্চ করের হার আরও বাড়ানোর পদক্ষেপটিও এর বড় দৃষ্টান্ত। গ্রাম পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে এমনকি স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা কিন্তু বাড়ছে। এদের অনেকেই কৃষক ও খুদে ব্যবসায় নিয়োজিত। শিক্ষার্থীও কম নেই। শূন্য কর-শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহার করে কিছু না কিছু করারোপের বেলায় এনবিআর ‘আইএমএফের শর্তের’ কথা মনে করিয়ে দিয়ে থাকে। সর্বসাধারণের ওপর প্রযোজ্য করহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিন্তু এ যুক্তি খাটে না। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর যে দাবি ছিল, সেটা অগ্রাহ্য করে দেওয়ার প্রস্তাবটি নাকি বহাল থাকছে। টাকা সাদা করা এবং এ ক্ষেত্রে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো প্রশ্ন না তোলার সুযোগটিও নাকি থাকছে বহাল। ব্যক্তির পাশাপাশি কোম্পানিকেও এবার এ সুযোগ দেওয়া হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধে! বৈষম্যমূলক করহারে এমন অনৈতিক সুযোগ কারা নেবে, তা জানা না গেলেও আমরা নিশ্চয় জানতে চাইব– নতুন অর্থবছরে কত টাকা সাদা হয়ে অর্থনীতির মূলধারায় যুক্ত হলো। এ ক্ষেত্রে কখনোই কিন্তু ‘সুফল’ তেমন মেলেনি।
বাজেট পাসের সময় কর প্রস্তাবে কিছু সংশোধনী এলেও এর আকার বা বিভিন্ন খাতের বরাদ্দে কম-বেশি হতে দেখা যায় না। বাজেটের আকার এবং এর বরাদ্দ নিয়েই কিন্তু এবার অনেক বেশি প্রশ্ন ওঠে। বাজেটে ঘোষিত মূল লক্ষ্যমাত্রা এবং এগুলোর অসংগতি নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। যেমন– বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমার সময় প্রবৃদ্ধি কীভাবে বাড়বে? চলতি অর্থবছরে প্রাক্কলনের চেয়ে প্রবৃদ্ধি অনেক কমে যাওয়ার পরও নতুন অর্থবছরে এটা কীভাবে পৌনে ৭ শতাংশ হবে, তা বোধগম্য নয়। সরকারি বিনিয়োগ তথা এডিপিও সামান্য বাড়ানো হয়েছে এবার। প্রবৃদ্ধিতে এডিপি বাস্তবায়নের প্রভাব তো খুবই কম আর স্বল্পমেয়াদে সেটা কমই হয় পরিলক্ষিত। তা ছাড়া চলতি বছরের মে পর্যন্ত এর যে অতিনিম্ন বাস্তবায়নের খবর মিলেছে, তাতে আগামী বছরও এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই শঙ্কা। এতে বেসরকারি শিল্প-বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অবস্থায় বাজেটে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত নয় বলেই মনে হচ্ছে। দেশে বেকারত্বের যে হাল, তাতে এটা কোনো আশার আলো দেখাচ্ছে না। বিনিয়োগ না বাড়লে রাজস্বের বড় লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে অর্জন করা যাবে, সেটাও প্রশ্ন। এটা মাথায় রেখেও বোধ হয় ব্যাংক খাত থেকে অনেক বেশি ঋণ নিয়ে ব্যয় নির্বাহের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এতে বেসরকারি খাত ঋণবঞ্চিত হলে কী প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে, সেটাও অনুমেয়। সুদের হার না কমায় বেসরকারি খাত কীভাবে বিদেশি ঋণ নিয়ে কাজ চালাবে, এটাও তো প্রশ্ন। দেশের শেয়ারবাজার পরিস্থিতি ভালো থাকলেও না হয় কথা ছিল।