অনুভূতিতে আঘাত, গণপিটুনি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি
বিশ শতকের আমেরিকান কবি অ্যাবেল মিরোপোল গণপিটুনির একটি আইকনিক ছবি দেখে বেদনার্ত হয়ে ‘স্ট্রেঞ্জ ফ্রুট’ কবিতাটি লিখেছিলেন, যেখানে দু’জন কৃষ্ণাঙ্গকে হাজারের বেশি শ্বেতাঙ্গ মিলে গণপিটুনি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেছিল। গণপিটুনি একটা প্রকাশ্য ও সরব ব্যাপার। প্রচলিত আইনকে অবজ্ঞা করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা অথবা আহত করা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে মনে করা হয়। সমাজে যখন বলপ্রয়োগ ও আধিপত্য স্বাভাবিক প্রবণতায় দেখা দেয়, তখন মানুষ যুক্তি আর সহিষ্ণুতা ভুলে যায়। আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে উত্তেজিত জনতা সম্মিলিতভাবে বিচার হাতে তুলে নেয়, যার নাম গণপিটুনি।
প্রায়ই দেখা যায়, ফেসবুকে ‘ধর্ম অবমাননা’ কিংবা ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙচুরের ‘সন্দেহে’ নিরীহ কাউকে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে; এমনকি পিটুনি দিয়ে হত্যাও করা হয়। সামাজিক মাধ্যম প্রচলনের পর এ ধরনের ঘটনা আগের তুলনায় বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের চেয়ে এখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, বলপ্রয়োগ মূল ভূমিকা পালনে করে। ধর্মীয় অনুভূতি শুধু অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালী কিংবা জনপ্রতিনিধিরা সেই পরিস্থিতিকে নিজেদের হিসাব-নিকাশ চুকানোর কাজে লাগায়।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের হিসাবে চলতি বছরের শুরু থেকে ৩১ মে পর্যন্ত গণপিটুনির অন্তত ৪৩টি ঘটনায় ৩৫ জন নিহত এবং ৪১ জন আহত হয়েছেন। তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ১৪৫টি। গণপিটুনির শিকার ব্যক্তিদের পরিচয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই গণপিটুনির শিকার নিরীহ মানুষ।
সর্বশেষ গত ১৯ মে ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গ্রামের কয়েকজন মানুষ অভিযুক্ত যুবক জয়ন্ত মণ্ডলকে (২২) বাড়ি থেকে ধরে এনে মারধর করে আটকে রাখে। শ্রীপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পুলিশকে ঘেরাও করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হামলাকারীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ছোড়ে। পরে বিকেলে পুলিশ জয়ন্ত মণ্ডলকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ অন্যদের সহযোগিতায় উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আটকে রাখে। এ সময় উত্তেজিত এলাকাবাসী আটক যুবকের বাড়ি এবং প্রতিবেশী আরেক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে হামলার শিকার যুবক জয়ন্ত মণ্ডলের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩-এর ২৮ ও ৩১ ধারায় মামলা করা হয়।
ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী ও কী কী কারণে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ আনা যেতে পারে– তা এখনও আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে অস্পষ্ট। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং সাম্প্রতিক সাইবার নিরাপত্তা আইনেও বিষয়টি স্পষ্ট নয়। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১ হাজার ৪৩৬টি মামলার মধ্যে ৫২৮টি মামলা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে।
জয়ন্ত মণ্ডলের বিরুদ্ধে কারা মামলা করেছে জানতে চাইলে থানা কর্তৃপক্ষ জানায়, জনগণ। সাধারণ জনগণ সাইবার নিরাপত্তা আইন সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান রাখে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকে যায়। ১৯৬০ সালের দণ্ডবিধির ২৯৫ থেকে ২৯৮ ধারায় তাদের আর ভরসা নেই, ভরসা নতুন বহুল সমালোচিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৮ আর ৩১ ধারায়; যেখানে অপরাধ একই রকম হলেও সাজা দ্বিগুণের বেশি।
আমাদের দেশে গণপিটুনির সাধারণত বিচার হতে দেখা যায় না। পুলিশ প্রথম দিকে তৎপর থাকলেও পরিস্থিতি থিতু হয়ে আসার পর গাছাড়া ভাব দেখায়। গণপিটুনির ঘটনাটি শুধু আক্রান্ত ব্যক্তি বা প্রাণ হারানো ব্যক্তির স্বজন ও পরিবারের দীর্ঘশ্বাস হয়ে টিকে থাকে।
অবশ্য অন্তত একটি গণপিটুনির ঘটনায় বিচারের নজির পাওয়া যায়। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে ঢাকার পাশেই আমিন বাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পর আদালত ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে কারাদণ্ডের আদেশ দেন। এখানেই শেষ নয়, বরং মামলাটি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে এখনও ঝুলে আছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিচার ব্যবস্থা
- গণপিটুনিতে নিহত